খালেদা জিয়ার একটি অখ্যাত ছবির গল্প

খালেদা জিয়ার একটি অখ্যাত ছবির গল্প

২০০৮-এ একবারই শেখ হাসিনাকে সাধারণ মানুষের কাতারে পেয়েছিলাম। জাতীয় নির্বাচনের প্রচার অভিযানের সময়। একটিই ছবি তুলতে পেরেছিলাম। তাও গাড়িতে বসা। তারপর তো তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। আর তার নাগাল পাওয়া গেল না। কখনোই না। ওই ২০০৮ থেকে ক্যামেরায় পেলাম শুধু বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে। বেশ কয়েকবার তার ছবি তোলার সুযোগ আমার হয়েছে। কাছ থেকে, দূর থেকে। কিন্তু এই ছবিটিই আমার সবচেয়ে পছন্দের। ২০১৫ সালে নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে তোলা।

সে সময় প্রথম আলোয় যোগ দিয়েছি মাত্র ৪-৫ মাস হলো। নিজের সক্ষমতা প্রমাণের ভীষণ চাপ। কারণ এর আগে ৭ বছর ছিলাম সাপ্তাহিক ২০০০-এ। দৈনিকওয়ালারা নাক সিঁটকাত, সাপ্তাহিকে কাজ করেছে যে ফটোগ্রাফার—সে কি পারবে দৈনিকের চাপ নিতে! তাও আবার দেশের প্রধান দৈনিকে! আমি জানতাম, পারব–পারতেই হতো।

যা হোক। বিএনপি চেয়ারপারসন সেদিন—মানে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল গুলশানের বাসা থেকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন। সেখান থেকে তার গাড়িবহরের সঙ্গে আমিও রওনা হই। তখন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচার চলছিল। তার গাড়ি অনুসরণের কারণ, যেকোনো সময় তার ওপর হামলা হতে পারে। এর আগে হয়েছে। দুদিন আগে—অর্থাৎ, ২০ এপ্রিল, কারওয়ানবাজার এলাকায় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের ওপর হামলা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ২১ এপ্রিলও তার গাড়িবহরকে ধাওয়া করে এক দল লোক। সুতরাং আজ যে হামলা হবে না, কে বলতে পারে!

গাড়ির পিছু নিয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত চলে আসার পরও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল না। একবার ভাবলাম, অফিসে চলে যাই। ওই মনে হওয়া পর্যন্তই। নয়াপল্টন পর্যন্ত যাব বলেই ঠিক করলাম। কখন কি হয়ে যায়—বলা তো যায় না। ভাবতে দেরি—হামলা হতে দেরি হলো না! গাড়িবহরটি বাংলামোটর এলাকায় আসতেই এক দল লোক লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়িসহ বেশ কয়েকটি গাড়ির কাচ ভেঙে ফেলে তারা। গাড়ি চলতে থাকায় এবং হামলার পর গতি বাড়িয়ে দেওয়ায় খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। চেয়ারপারসনের গাড়িবহর চলে যাওয়ার পর হামলাকারীরা আমাদের ওপর চড়াও হলো—আমরা যারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে ছবি তুলছিলাম।

কোনোমতে সেখান থেকে বেঁচে নয়াপল্টন পৌঁছাই। তখনো খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নামেননি। তারপরও বুঝলাম, আমার পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেছে। আরও বোঝা গেল, তার কাছে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমি ছোটখাটো মানুষ—সিনিয়রদের সঙ্গে পেরে উঠব না, মেরেও বসতে পারে। আমাকে দূর থেকেই ছবি তুলতে হবে। খালেদা জিয়া বিএনপি কার্যালয়ে ঢুকবেন, তার আগেই আমি ঢুকে পড়লাম। ফটোসাংবাদিক আমি একাই। ভবনের কেঁচিগেট তখনো পুরো খোলা নয়। দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি। পরিকল্পনা ছিল–তিনি যখন উঠতে থাকবেন, আমি তার সামনে থেকে ছবি তুলতে থাকব।

আমি ভেতর থেকে দেখছি, তিনি আসছেন। তার আর আমার ক্যামেরার সামনে সেই কেঁচিগেট। গেটটাকে ফ্রেম করে টেলিলেন্সে আমি তার ছবি তুললাম। খালেদা জিয়ার গুলশান থেকে নয়াপল্টনে আসা টাইমলাইনের অনেক ছবি তুলেছি। কিন্তু ওই একটি ছবিই ‘ছবি’হয়ে উঠেছে বলে মনে হলো। ওই যে বলা হয় তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’, ছবিটিতে তার সেই পরিচয়টি যেন ফুটে উঠেছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে তিনি সেসময় যে রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তার একটি প্রতীকী দৃশ্য ছবিটিতে ধরা পড়েছে বলে মনে হয়েছে।

রাজনৈতিক ছবিগুলোর মধ্যে এটি আমার যতই প্রিয় হোক, অন্য কারও পছন্দ হয়নি। ছবিটি পত্রিকায় ছাপা হয়নি। রাজনীতির যে ছবিগুলো পত্রিকায় ছাপা হয়—সেগুলো ভীষণ গতানুগতিক, সোজাসাপ্টা, সরাসরি ও মূর্ত। রাজনীতির ছবিরও অন্তর্নিহিত অর্থ থাকতে পারে, তাতে থাকতে পারে বিমূর্ততাও। খালেদা জিয়ার এই ছবিটিতে তা আছে বলে অন্তত আমার মনে হয়।

লেখক: প্রধান, ভিডিও বিভাগ, চরচা

সম্পর্কিত