প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত বিশ্বের এক বিশাল অংশ একটি পরিচিত উৎসবের আবহে প্রবেশ করে। এর অবিচ্ছেদ্য অংশ বড়দিনের গান, আলোকসজ্জা, সাজানো গাছ, কেনাকাটার তোড়জোড় ও স্নিগ্ধ তুষারভেজা রাত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ডিসকোর্সে প্রায়ই ‘পাশ্চাত্য খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ’এমনকি ‘ইহুদি–খ্রিষ্টান সভ্যতা’র মতো অস্পষ্ট ধারণাগুলো উঠে আসে। এই শব্দগুচ্ছ এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে যে, অনেকে প্রায় অবচেতনভাবে ধরেই নেন যে, খ্রিষ্টধর্ম সহজাতভাবেই একটি পাশ্চাত্য ধর্ম, যা ইউরোপীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরিচয়েরই এক বহিঃপ্রকাশ।
খ্রিষ্টধর্ম শুরু থেকেই মূলত একটি পশ্চিম এশীয় বা মধ্যপ্রাচ্যের ধর্ম। এর ভৌগোলিক অবস্থান, সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও এর গোড়াপত্তনের কাহিনিগুলোর শেকড় এই মাটিতেই। এসবের সঙ্গে ইউরোপের চেয়ে বর্তমানের ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও জর্ডানের অনেক বেশি মিল রয়েছে। এমনকি ‘ইহুদি-খ্রিষ্টান মূল্যবোধ’ শব্দগুচ্ছ দিয়ে যে ইহুদি ধর্মের উল্লেখ করা হয়, তাও পুরোপুরি একটি মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়। পাশ্চাত্য খ্রিষ্টধর্মকে কেবল গ্রহণ করেছে, পাশ্চাত্য কখনোই এই ধর্মের জন্মভূমি ছিল না।
খ্রিষ্টধর্মের আদি উৎস এবং এর সমসাময়িক পাশ্চাত্য রূপের মধ্যকার দূরত্ব সম্ভবত বড়দিনের চেয়ে স্পষ্টভাবে আর কিছুতেই ফুটে ওঠে না। বড়দিন মূলত একজন ফিলিস্তিনি ইহুদির জন্মের কাহিনি, যে কিনা এই মাটিরই এক সন্তান, যার জন্ম হয়েছিল আধুনিকতা ও পরিচয়-তত্ত্বের (আইডেন্টিটি সম্পর্কিত ধারণা) বহু আগে।
পাশ্চাত্যের বড়দিন আসলে কেমন
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বড়দিন এখন একটি সাংস্কৃতিক বাজারে পরিণত হয়েছে। এটিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও রোমান্টিক রূপ দেওয়া হয়েছে এবং এর ওপর লেপে দেওয়া হয়েছে সেন্টিমেন্টের আস্তরণ। সেখানে জাঁকজমকপূর্ণ উপহার আদান-প্রদানের সংস্কৃতিতে আড়াল হয়ে যায় দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতার বিষয়টি। বড়দিনের মৌসুমটি এখন কেবল প্রাচুর্য, নস্টালজিয়া ও ভোগবাদের প্রদর্শনীর বিষয়। এটি ধর্মতাত্ত্বিক ও নৈতিক মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত এক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা। ছবি: রয়টার্সযিশুর জন্মের আখ্যান কোনো সুখকর পরিস্থিতি ছিল না। বরং তার জন্ম হয়েছিল চরম অস্থিরতার মাঝে। কিন্তু পাশ্চাত্যের বড়দিনের জনপ্রিয় গান ‘সাইলেন্ট নাইট’এই কাহিনির প্রকৃত রূপকে আড়াল করে রাখে।
তিনি জন্মেছিলেন এক সামরিক দখলদারত্বের অধীনে। সাম্রাজ্যবাদী ফরমানের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল খ্রিষ্টের পরিবার। তার জন্মের সময় ওই অঞ্চল খুবই অশান্ত আর সহিংস অবস্থায় ছিল। তার পরিবার শরণার্থী হিসেবে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
কারণ, গসপেলের বর্ণনা অনুযায়ী, নিজের শাসন টিকিয়ে রাখতে মরিয়া এক ভীত অত্যাচারী শাসকের আদেশে বেথলেহেমের শিশুদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই গল্পটা বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে না?
প্রকৃতপক্ষে, বড়দিনের এই উপাখ্যান হলো সাম্রাজ্যবাদ, অবিচার এবং এর যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের এক বাস্তব আখ্যান।
বেথলেহেম: কল্পনা বনাম বাস্তবতা
পাশ্চাত্যের অনেক মানুষের কাছে যিশুর জন্মস্থান বেথলেহেম কেবলই একটি কল্পনার জগৎ, প্রাচীনকালের কোনো এক চিত্রপট, যা সময়ের আবর্তে স্থির হয়ে আছে। পাশ্চাত্যের সামনে বেথলেহেম কোনো বাস্তব শহর নয়, যেখানে রক্তমাংসের মানুষ কিংবা স্বতন্ত্র ইতিহাস ও সংস্কৃতি রয়েছে। বরং এটি কেবল ধর্মগ্রন্থের পাতায় বর্ণিত একটি নিরিবিলি গ্রাম হিসেবেই স্মৃতিতে অমলিন।
আজকের বেথলেহেম এক দখলদার শক্তির দেয়াল আর চেকপোস্ট দিয়ে ঘেরা। এখানকার বাসিন্দারা বর্ণবৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতার এক ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করছেন। অনেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অনুভব করেন। এই বিচ্ছিন্নতা শুধু জেরুজালেম থেকেই নয় (যেখানে যাওয়ার অনুমতি দখলদার শক্তি এখন তাদেরকে দেয় না), বরং বিশ্বজুড়ে খ্রিষ্টানদের সেই কল্পনা থেকেও, যা বেথলেহেমের অতীতকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেও এর বর্তমান দুর্দশাকে প্রায়ই উপেক্ষা করে।
তাদের এই মনোভাবটিই ব্যাখ্যা করে যে, কেন পাশ্চাত্যের বহু মানুষ বড়দিন উদ্যাপন করলেও বেথলেহেমের খ্রিষ্টানদের বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হলো–অনেকে এমন সব ধর্মতত্ত্ব ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন, যা আজকের সাম্রাজ্যবাদী ইসরায়েলকে সমর্থন করতে গিয়ে আমাদের অস্তিত্বকেই পুরোপুরি খারিজ করে দেয়।
বড়দিন উদযাপন করছেন ইউরোপের জনগণ। ছবি: রয়টার্সতারা প্রাচীন বেথলেহেমকে একটি পবিত্র ধারণা হিসেবে পরম মমতায় লালন করে। কিন্তু আধুনিক বেথলেহেম, যেখানে ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানরা অবর্ণনীয় কষ্ট আর টিকে থাকার লড়াই এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা, তাকে সবাই এড়িয়ে যেতে চায়।
এই বিচ্ছিন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টানরা ভুলে যান যে, বেথলেহেম একটি বাস্তব স্থান, তখন তারা আসলে তাদের নিজেদের আধ্যাত্মিক শিকড় থেকেই বিচ্যুত হয়ে পড়েন। আর যখন তারা বেথলেহেমের বাস্তবতাকে ভুলে যান, তখন তারা বড়দিনের এই কাহিনি যে একটি বাস্তব সত্য, সেটিও ভুলে যান।
তারা ভুলে যান যে, এই কাহিনি এমন এক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয়েছিল, যারা এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনে বাস করত, যারা বাস্তুচ্যুতির সম্মুখীন হয়েছিল, যারা ন্যায়বিচারের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষায় ছিল এবং যারা বিশ্বাস করত যে, ঈশ্বর তাদের থেকে দূরে নন, বরং তাদের মধ্যেই আছেন।
বেথলেহেমের কাছে বড়দিনের তাৎপর্য কী
তাহলে সেই মানুষের কাছে বড়দিনের রূপ কেমন, যারা আজও সেখানেই বাস করছেন, যেখানে এই সবকিছুর শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ, ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানরা, যে ক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় গত দুই সহস্রাব্দ ধরে তাদের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রেখেছে, তাদের কাছে বড়দিনের অর্থই-বা কী?
তাদের কাছে বড়দিন হলো ইশ্বরের সাথে একাত্ম হওয়ার আখ্যান।
এটি এমন এক ঈশ্বরের গল্প, যিনি দূর থেকে শাসন করেন না, বরং মানুষের মাঝে উপস্থিত থাকেন এবং প্রান্তিক মানুষের পক্ষ নেন। অবতারবাদ; অর্থাৎ, ঈশ্বর রক্তমাংসের দেহ ধারণ করেছেন–এই বিশ্বাসটি কেবল কোনো বিমূর্ত দার্শনিক তত্ত্ব নয়। এটি ঈশ্বর কোথায় বাস করতে পছন্দ করেন, সেই সম্পর্কে একটি আমূল বৈপ্লবিক ঘোষণা। তিনি বাস করেন অরক্ষিত অবস্থায়, দারিদ্র্যের মাঝে, দখলদারত্বের নিচে পিষ্ট হওয়া মানুষের মাঝে এবং আশা ছাড়া যাদের আর কোনো শক্তি নেই, সেই অসহায়দের মধ্যে। বেথলেহেমের এই উপাখ্যানে, ঈশ্বর কোনো সম্রাট বা অধিপতির সঙ্গে নিজেকে মেলান না। বরং সাম্রাজ্যবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া মানুষদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেন। ঈশ্বর কোনো যোদ্ধা হিসেবে আসেন না, আসেন এক নবজাতক হিসেবে। তার উপস্থিতি কোনো রাজপ্রাসাদে নয়, বরং দারিদ্র্যে। ঐশ্বরিক সংহতির সবচেয়ে বিস্ময়কর রূপ–ঈশ্বর মানবজাতির সবচেয়ে অসহায় অংশের সাথে যোগ দেন।
সুতরাং বড়দিন হলো সাম্রাজ্যবাদের যুক্তিকে ইশ্বরের করা সরাসরি চ্যালেঞ্জ।
আজকের ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি কেবল কোনো ধর্মতত্ত্ব নয়। এখন এটিই তাদের জীবন। আমরা ফিলিস্তিনিরা যখন বড়দিনের কাহিনি পড়ি, তখন আমরা আমাদের নিজেদের জগতকেই সেখানে খুঁজে পাই। পবিত্র সেই পরিবারের পলায়নের কাহিনি আজকের দিনের তল্লাশিচৌকি, আমলাতান্ত্রিক বাধা এবং যুদ্ধবিগ্রহ থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ শরণার্থীর জীবনের প্রতিধ্বনি। হেরোডের সেই সহিংসতা আজ আমাদের চারপাশে দেখা সহিংসতারই প্রতিফলন। বড়দিন আক্ষরিক অর্থেই এক অনন্য ফিলিস্তিনি উপাখ্যান।
বিশ্ববাসীর প্রতি বার্তা
বেথলেহেমে এবার দুই বছর পর বড়দিন পালিত হচ্ছে। তবে সেখানে কোনো উৎসব নেই। বড়দিন পালন না করতে পারা আমাদের কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু যিশুর জন্মভূমিতেই যখন গণহত্যা চলে, ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে প্রতিনিয়ত নিষ্পাপ শিশুদের লাশ বের করতে হয়, সেখানে আমরা কীভাব মহাসমারোহে যিশুর জন্মদিন পালন করব?
কিন্তু এই যে আমরা দুই বছর পর বড়দিন পালন করছি, তার মানে এই নয় যে, গণহত্যা শেষ হয়েছে কিংবা যুদ্ধের অবসান হয়েছে। সেই বর্ণবাদও শেষ হয়নি। আমরা এখনো দখলদারদের হাতে বন্দী। বরং আমাদের এই উদ্যাপন হলো এক ধরনের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। আমরা যে এখনো টিকে আছি, বেথলেহেম এখনো বড়দিনের রাজধানী হয়ে আছে এবং এই শহরের যে আখ্যান, তা চিরন্তন–এটা তারই ঘোষণা।
এখন এমন এক সময়, যখন পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক আলোচনায় খ্রিষ্টধর্মকে শুধু একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যখন প্রায়শই সেইসব মানুষকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, যাদের মধ্যে এই ধর্মের জন্ম হয়েছিল, তখন এই কাহিনির মূলে ফিরে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই বড়দিনে, বিশ্বজুড়ে গির্জাগুলোর প্রতি এবং বিশেষ করে পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টানদের প্রতি আমাদের আহ্বান হলো–এই কাহিনিটি ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়েছিল, তা স্মরণ করা। এটি মনে রাখা যে, বেথলেহেম কোনো রূপকথা নয়; বরং এমন একটি জায়গা, যেখানে আজও মানুষ বসবাস করে। খ্রিষ্টান সমাজ যদি বড়দিনের প্রকৃত অর্থকে সম্মান জানাতে চায়, তবে তাদের অবশ্যই বেথলেহেমের দিকে তাকাতে হবে। আর তা কল্পনার বেথলেহেম নয়, বরং বাস্তবের বেথলেহেমের দিকে। সেই বেথলেহেমের দিকে, যেখানকার মানুষ আজও ন্যায়বিচার, মর্যাদা ও শান্তির জন্য আর্তনাদ করছে।
বেথলেহেমকে স্মরণ করার অর্থ হলো এটি মনে রাখা যে, ঈশ্বর নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ান এবং যিশুর অনুসারীদেরও ঠিক তা-ই করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
লেখক: ফিলিস্তিনি যাজক এবং ধর্মতত্ত্ববিদ। তিনি রামাল্লার ‘হোপ ইভানজেলিক্যাল লুথারান চার্চ’-এর যাজক হিসেবে দায়িত্বরত এবং ‘বেথলেহেম ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’-এর পরিচালক
লেখাটি আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন রিতু চক্রবর্ত্তী