থমাস কারোথার্স ও ম্যাকেঞ্জি ক্যারিয়ার

গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক গণতন্ত্র একটি দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। কোনো কোনো দেশ গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার ও নবায়নের সম্ভাব্য পথে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। আবার অনেক দেশেই গণতন্ত্র ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
২০২৫ সালের শেষে এসে বিশ্বের দশটি দেশের দিকে তাকালে, এই অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তা বোঝা যায়। প্রথম দলে রয়েছে পাঁচটি গণতান্ত্রিক দেশ, যে দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন কারণে গণতন্ত্র ঝুঁকির উদ্বেগজনক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় দলে থাকা পাঁচটি দেশ বর্তমানে শক্তিশালী স্বৈরাচারবিরোধী বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর কিছু ক্ষেত্রে তা অর্থবহ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ খুলে দিয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী নেতৃত্ব ও বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্বের ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সব দেশেই স্বৈরাতন্ত্রবিরোধিতা ক্রমেই বাড়ছে।
এই দশটি উদাহরণ মূল্যায়ন করলে আগামী বছরে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের অগ্রগতি না পশ্চাদপসরণ–কোনটি ঘটতে পারে, তা নির্ধারণে কিছুটা সহায়ক হবে। জেনে নেওয়া যাক গণতন্ত্রের দিকে উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর ব্যাপারে।
সার্বিয়া
গত এক বছরে সার্বিয়ার তরুণরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার ভুচিচ বিক্ষোভের মুখোমুখি হলেও বর্তমান এই আন্দোলন এখনও পর্যন্ত তার ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই বিক্ষোভের সূচনা হয় ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে, যখন নোভি সাদ রেলওয়ে স্টেশন ধসে পড়ে এবং এতে ১৬ জন নিহত হয়। এরপর থেকে বিক্ষোভটি ধীরে ধীরে সরকারী দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের অবসানের দাবিতে একটি বিস্তৃত গণআন্দোলনে রূপ নেয়। সারা দেশে এই প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে এবং উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন লাভ করে। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট ভুচিচ ভিন্নমত দমনে স্বৈরতান্ত্রিক কৌশল গ্রহণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে বিক্ষোভকারীদের হয়রানি, গ্রেপ্তার ও গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি।
এই আন্দোলনের প্রধান দাবি হলো আগাম নির্বাচন, যার মাধ্যমে ভুচিচের দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার আশা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের নভেম্বরের শুরুতে যখন হাজার হাজার সার্বিয়ান রাস্তায় নেমে আসে, তখন ভুচিচ জনগণের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকা সংসদীয় নির্বাচন এগিয়ে আনার প্রস্তাব দেন। তবে তিনি আদৌ সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন কি না এবং করলে সেই নির্বাচন সার্বিয়ার রাজনীতির গতিপথে বাস্তব কোনো পরিবর্তন আনবে কি না—তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদি ভুচিচ তার কথা না রাখেন, তাহলে ২০২৬ সালে মূল প্রশ্ন হবে এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে এবং ভুচিচ আরও কঠোর কর্তৃত্ববাদী পথে অগ্রসর হবেন কি না।
বাংলাদেশ
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সরকার যখন সহিংসভাবে আন্দোলন দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন প্রতিবাদ দ্রুতই সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনামলে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনরোষ এই আন্দোলনকে আরও উসকে দেয়। সহিংসতা এক পর্যায়ে তীব্র রূপ ধারণ করে, যেখানে আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হন। আন্দোলনের চাপে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার দায়িত্ব পান খ্যাতনামা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থন পায়।
তবে পরবর্তী এক বছরে খুব বেশি রাজনৈতিক অগ্রগতি হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুত সংস্কার বাস্তবায়নে সফল হতে পারেনি। রাজনীতি এখনও মেরুকরণের মধ্যে আবদ্ধ। সেনাবাহিনী এখনও উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা বজায় রেখেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো এখনো উদ্বেগের বিষয়। একই সঙ্গে দুর্নীতি ও দুর্বল অর্থনীতি তরুণদের প্রধান অভিযোগ হিসেবে এখনও বিদ্যমান।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা ক্রমেই বাড়ছে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ শুরু থেকে এর বিরোধিতা করে আসছে। গত মে মাসে এই সরকার আসন্ন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে। এ সিদ্ধান্ত নির্বাচনটির ন্যায্যতা নিয়ে সমালোচনার জন্ম দেয় এবং এর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানান। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, ছাত্র আন্দোলনে সহিংস দমন-পীড়নের দায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ ব্যাপক বিক্ষোভ ও হরতালের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ এবং হাসিনার সাজা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে।
মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী পক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। অনেকেই আশা করছেন, এই নির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে আরও সক্ষম হবে। তবে আসন্ন নির্বাচনের গণতান্ত্রিক চরিত্র, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ আন্দোলন, এবং পরবর্তী সময়ে নতুন সরকারের গণতন্ত্রপন্থী সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের সক্ষমতা—সবকিছুই বাংলাদেশের সম্ভাব্য পুনরায় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে কঠিন পরীক্ষা হিসেবে আবির্ভূত হবে।
মাদাগাস্কার
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাদাগাস্কারের তরুণরা দেশজুড়ে পানি ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পাশাপাশি অভিজাত শ্রেণির দুর্নীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনে নামেন। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে এই বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যখন বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ ঘটে। প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা বিক্ষোভকারীদের দাবি মেটানোর চেষ্টা হিসেবে তার প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন, সরকার ভেঙে দেন এবং সংস্কার শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তরুণ বিক্ষোভকারীরা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন।
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মাদাগাস্কার সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সামরিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। রাজোয়েলিনা দেশত্যাগ করেন এবং কর্নেল মাইকেল র্যানড্রিয়ানিরিনা ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি নিজের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন এবং সংবিধান স্থগিত করেন।
র্যানড্রিয়ানিরিনা আগামী দুই বছরের মধ্যে একটি নির্বাচিত বেসামরিক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে সামরিক সমর্থিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়ে গেছে।
নেপাল
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপালে তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ শুরু হয়, যখন সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার সহিংস হয়ে উঠলে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবনগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়, প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে নির্বাচিত করেন।
নতুন সরকার ২০২৬ সালের মার্চে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এই সময়সূচিকে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল সমালোচনা করেছে, কারণ এই ভোটের ফলে আগের ব্যবস্থাই প্রতিস্থাপন হবে। পর্যবেক্ষকরাও উদ্বিগ্ন যে এই সরকার হয়তো নির্বাচন কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারবে না। তারা ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি ভবন, নির্বাচনী সামগ্রীর অভাব এবং নিরাপত্তার ঘাটতি সংক্রান্ত জটিলতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
সিরিয়া
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন হয় হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বে, এই দলের নেতা আহমদ আল-শারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার প্রতিশ্রুতি দেন, যা শেষপর্যন্ত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এই অন্তর্বর্তী সরকার একটি প্রাথমিক সংসদ স্থাপন করে এবং খসড়া সংবিধান ঘোষণা করে, যেখানে আগামী পাঁচ বছরের কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ সিরীয় আহমদ আল-শারার উপর আস্থা রাখেন এবং ৭৩ শতাংশ মনে করেন যে তারা এখন বক্তৃতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা উপভোগ করছেন।
তবে কিছু পর্যবেক্ষক উদ্বিগ্ন যে আল-শারাকে ঘিরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ব্যবস্থা গড়ে উঠছে এবং আল-শারা বিচারিক ও সংসদীয় প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী অবস্থান নিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এখনও বিতর্কিত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে, উত্তরে তুর্কি, কুর্দি এবং আল-শারার বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছেই, এবং দক্ষিণে ইসরায়েলি দখল ও দ্রুজ বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি বাড়ছে বা নতুন গণতান্ত্রিক সুযোগ তৈরি হচ্ছে তা বোঝার জন্য এই দশটি উদাহরণ যথেষ্ঠ নয়। তবে এই উদাহরণগুলো বৈশ্বিক গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটপূর্ণ মুহূর্তে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে: কোথায় এবং কখন প্রতিবাদ, গণআন্দোলন ও অন্যান্য প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ রাজনৈতিক নেতাদের স্বৈরাচারী হওয়াকে বাধাগ্রস্থ করবে? আগামী এক বছরে এদের গতিপথ বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ ধারা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেবে।
লেখা: ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের নিবন্ধ
লেখক: থমাস ক্যারোথার্স হার্ভে ভি. ফাইনবার্গ চেয়ার ফর ডেমোক্রেসি স্টাডিজ ও ডেমোক্রেসি, কনফ্লিক্ট, অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রামের পরিচালক।

গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক গণতন্ত্র একটি দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। কোনো কোনো দেশ গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার ও নবায়নের সম্ভাব্য পথে যাত্রা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। আবার অনেক দেশেই গণতন্ত্র ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
২০২৫ সালের শেষে এসে বিশ্বের দশটি দেশের দিকে তাকালে, এই অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তা বোঝা যায়। প্রথম দলে রয়েছে পাঁচটি গণতান্ত্রিক দেশ, যে দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন কারণে গণতন্ত্র ঝুঁকির উদ্বেগজনক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় দলে থাকা পাঁচটি দেশ বর্তমানে শক্তিশালী স্বৈরাচারবিরোধী বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর কিছু ক্ষেত্রে তা অর্থবহ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ খুলে দিয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী নেতৃত্ব ও বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্বের ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সব দেশেই স্বৈরাতন্ত্রবিরোধিতা ক্রমেই বাড়ছে।
এই দশটি উদাহরণ মূল্যায়ন করলে আগামী বছরে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের অগ্রগতি না পশ্চাদপসরণ–কোনটি ঘটতে পারে, তা নির্ধারণে কিছুটা সহায়ক হবে। জেনে নেওয়া যাক গণতন্ত্রের দিকে উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর ব্যাপারে।
সার্বিয়া
গত এক বছরে সার্বিয়ার তরুণরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার ভুচিচ বিক্ষোভের মুখোমুখি হলেও বর্তমান এই আন্দোলন এখনও পর্যন্ত তার ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই বিক্ষোভের সূচনা হয় ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে, যখন নোভি সাদ রেলওয়ে স্টেশন ধসে পড়ে এবং এতে ১৬ জন নিহত হয়। এরপর থেকে বিক্ষোভটি ধীরে ধীরে সরকারী দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের অবসানের দাবিতে একটি বিস্তৃত গণআন্দোলনে রূপ নেয়। সারা দেশে এই প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে এবং উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন লাভ করে। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট ভুচিচ ভিন্নমত দমনে স্বৈরতান্ত্রিক কৌশল গ্রহণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে বিক্ষোভকারীদের হয়রানি, গ্রেপ্তার ও গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি।
এই আন্দোলনের প্রধান দাবি হলো আগাম নির্বাচন, যার মাধ্যমে ভুচিচের দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার আশা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের নভেম্বরের শুরুতে যখন হাজার হাজার সার্বিয়ান রাস্তায় নেমে আসে, তখন ভুচিচ জনগণের দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকা সংসদীয় নির্বাচন এগিয়ে আনার প্রস্তাব দেন। তবে তিনি আদৌ সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন কি না এবং করলে সেই নির্বাচন সার্বিয়ার রাজনীতির গতিপথে বাস্তব কোনো পরিবর্তন আনবে কি না—তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদি ভুচিচ তার কথা না রাখেন, তাহলে ২০২৬ সালে মূল প্রশ্ন হবে এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে এবং ভুচিচ আরও কঠোর কর্তৃত্ববাদী পথে অগ্রসর হবেন কি না।
বাংলাদেশ
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সরকার যখন সহিংসভাবে আন্দোলন দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন প্রতিবাদ দ্রুতই সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনামলে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনরোষ এই আন্দোলনকে আরও উসকে দেয়। সহিংসতা এক পর্যায়ে তীব্র রূপ ধারণ করে, যেখানে আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হন। আন্দোলনের চাপে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার দায়িত্ব পান খ্যাতনামা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকার সেনাবাহিনীর সমর্থন পায়।
তবে পরবর্তী এক বছরে খুব বেশি রাজনৈতিক অগ্রগতি হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুত সংস্কার বাস্তবায়নে সফল হতে পারেনি। রাজনীতি এখনও মেরুকরণের মধ্যে আবদ্ধ। সেনাবাহিনী এখনও উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা বজায় রেখেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো এখনো উদ্বেগের বিষয়। একই সঙ্গে দুর্নীতি ও দুর্বল অর্থনীতি তরুণদের প্রধান অভিযোগ হিসেবে এখনও বিদ্যমান।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা ক্রমেই বাড়ছে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ শুরু থেকে এর বিরোধিতা করে আসছে। গত মে মাসে এই সরকার আসন্ন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে। এ সিদ্ধান্ত নির্বাচনটির ন্যায্যতা নিয়ে সমালোচনার জন্ম দেয় এবং এর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানান। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, ছাত্র আন্দোলনে সহিংস দমন-পীড়নের দায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ ব্যাপক বিক্ষোভ ও হরতালের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগ এবং হাসিনার সাজা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে।
মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী পক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। অনেকেই আশা করছেন, এই নির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে আরও সক্ষম হবে। তবে আসন্ন নির্বাচনের গণতান্ত্রিক চরিত্র, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ আন্দোলন, এবং পরবর্তী সময়ে নতুন সরকারের গণতন্ত্রপন্থী সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের সক্ষমতা—সবকিছুই বাংলাদেশের সম্ভাব্য পুনরায় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে কঠিন পরীক্ষা হিসেবে আবির্ভূত হবে।
মাদাগাস্কার
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাদাগাস্কারের তরুণরা দেশজুড়ে পানি ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পাশাপাশি অভিজাত শ্রেণির দুর্নীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনে নামেন। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে এই বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যখন বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ ঘটে। প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা বিক্ষোভকারীদের দাবি মেটানোর চেষ্টা হিসেবে তার প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন, সরকার ভেঙে দেন এবং সংস্কার শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তরুণ বিক্ষোভকারীরা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন।
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মাদাগাস্কার সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সামরিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। রাজোয়েলিনা দেশত্যাগ করেন এবং কর্নেল মাইকেল র্যানড্রিয়ানিরিনা ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি নিজের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন এবং সংবিধান স্থগিত করেন।
র্যানড্রিয়ানিরিনা আগামী দুই বছরের মধ্যে একটি নির্বাচিত বেসামরিক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে সামরিক সমর্থিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়ে গেছে।
নেপাল
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপালে তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ শুরু হয়, যখন সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার সহিংস হয়ে উঠলে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবনগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়, প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে নির্বাচিত করেন।
নতুন সরকার ২০২৬ সালের মার্চে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এই সময়সূচিকে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল সমালোচনা করেছে, কারণ এই ভোটের ফলে আগের ব্যবস্থাই প্রতিস্থাপন হবে। পর্যবেক্ষকরাও উদ্বিগ্ন যে এই সরকার হয়তো নির্বাচন কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারবে না। তারা ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি ভবন, নির্বাচনী সামগ্রীর অভাব এবং নিরাপত্তার ঘাটতি সংক্রান্ত জটিলতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
সিরিয়া
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন হয় হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বে, এই দলের নেতা আহমদ আল-শারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার প্রতিশ্রুতি দেন, যা শেষপর্যন্ত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এই অন্তর্বর্তী সরকার একটি প্রাথমিক সংসদ স্থাপন করে এবং খসড়া সংবিধান ঘোষণা করে, যেখানে আগামী পাঁচ বছরের কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ সিরীয় আহমদ আল-শারার উপর আস্থা রাখেন এবং ৭৩ শতাংশ মনে করেন যে তারা এখন বক্তৃতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা উপভোগ করছেন।
তবে কিছু পর্যবেক্ষক উদ্বিগ্ন যে আল-শারাকে ঘিরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ব্যবস্থা গড়ে উঠছে এবং আল-শারা বিচারিক ও সংসদীয় প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী অবস্থান নিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এখনও বিতর্কিত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে, উত্তরে তুর্কি, কুর্দি এবং আল-শারার বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছেই, এবং দক্ষিণে ইসরায়েলি দখল ও দ্রুজ বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি বাড়ছে বা নতুন গণতান্ত্রিক সুযোগ তৈরি হচ্ছে তা বোঝার জন্য এই দশটি উদাহরণ যথেষ্ঠ নয়। তবে এই উদাহরণগুলো বৈশ্বিক গণতন্ত্রের বর্তমান সংকটপূর্ণ মুহূর্তে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে: কোথায় এবং কখন প্রতিবাদ, গণআন্দোলন ও অন্যান্য প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ রাজনৈতিক নেতাদের স্বৈরাচারী হওয়াকে বাধাগ্রস্থ করবে? আগামী এক বছরে এদের গতিপথ বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ ধারা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেবে।
লেখা: ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের নিবন্ধ
লেখক: থমাস ক্যারোথার্স হার্ভে ভি. ফাইনবার্গ চেয়ার ফর ডেমোক্রেসি স্টাডিজ ও ডেমোক্রেসি, কনফ্লিক্ট, অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রামের পরিচালক।

চাকরি বা কর্মসংস্থান কেবল অর্থ উপার্জন বা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নয়, এটি মানুষকে সম্মানও এনে দেয়। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১ কোটি ৪০ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মক্ষম বয়সে পৌঁছালেও এই সময়ে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছে মাত্র ৮৭ লাখ নতুন চাকরি। তার মানে প্রায় অর্ধেক তরুণ এই সময়ে কর্মসংস্থান পায়নি