রক্ত দেখলে কেন অনেকে অজ্ঞান হয়ে যান

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
রক্ত দেখলে কেন অনেকে অজ্ঞান হয়ে যান
প্রতীকী ছবি/ফ্রিপিক

অনেকেই রক্ত দেখলে সহ্য করতে পারেন না, অজ্ঞানও হয়ে যান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ’। এটি একটি পরিচিত শারীরিক প্রতিক্রিয়া, যার পেছনে কাজ করে স্ট্রেসের প্রতি শরীরের স্বাভাবিক সাড়া।

আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন মেডিসিনের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অখিল নারাং বলেন, “সাময়িকভাবে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে গেলে অজ্ঞান হওয়া বা সিনকোপ হওয়ার ঘটনা ঘটে। হঠাৎ হৃদস্পন্দন বা রক্তচাপ কমে গেলে এমনটি হতে পারে, যার ফলে স্বল্প সময়ের জন্য জ্ঞান হারিয়ে যায়।”

ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ কী?

ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ হলো রিফ্লেক্স সিনকোপের একটি ধরন-অর্থাৎ, এটি স্নায়ুতন্ত্রের হঠাৎ প্রতিক্রিয়ার কারণে ঘটে।

ডা. অখিল বলেন, “রক্ত দেখা বা তীব্র মানসিক চাপের সময় শরীর অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তখন ভেগাস নার্ভ সক্রিয় হয়, যা হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ও হজম প্রক্রিয়ার মতো অচেতন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।”

এই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার ফলে হঠাৎ রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন কমে যায়, রক্তনালিগুলো প্রশস্ত হয় এবং মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ হ্রাস পায়। ফলে মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা বা সাময়িকভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়া ঘটতে পারে।

ডা. অখিল নারাংয়ের ভাষ্য, “প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ জীবনে অন্তত একবার সিনকোপের অভিজ্ঞতা পান।”

কারা বেশি অজ্ঞান হন?

ডা. অখিল জানান, “যেকোনো বয়সেই অজ্ঞান হওয়া ঘটতে পারে। তবে ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ সাধারণত তরুণ ও শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। পানিশূন্যতা, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা বা মানসিক চাপ এ ঝুঁকি বাড়ায়।”

অনেকে মনে করেন, অজ্ঞান হওয়া মানেই মৃগী বা হৃদরোগ। তবে এ ধারণা সঠিক নয় বলে মত দেন এই চিকিৎসক।

ডা. অখিলের মতে, কিছু ক্ষেত্রে এটি হৃদরোগের লক্ষণ হতে পারে, কিন্তু ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপের বেশিরভাগ ঘটনাই হৃদযন্ত্রের সমস্যার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।

ভেগাস নার্ভ মানসিক ও শারীরিক চাপের প্রতি সংবেদনশীল। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে রক্ত দেখাই এই নার্ভকে সক্রিয় করার জন্য যথেষ্ট।

প্রতীকী ছবি/ফ্রিপিক
প্রতীকী ছবি/ফ্রিপিক

অজ্ঞান হওয়ার আগে শরীর সাধারণত কিছু সতর্ক সংকেত দেয়। যেমন- মাথা হালকা লাগা, মাথা ঘোরা, ঘাম হওয়া বা হাত ভিজে যাওয়া, চোখে ঝাপসা বা টানেল ভিশন, কানে শব্দ শোনা, বমিভাব বা দুর্বলতা, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।

মার্কিন চিকিৎসক ডা. অখিল নারাং বলেন, “এই উপসর্গগুলো কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিটের মধ্যে দেখা দেয়। এগুলো আসলে শরীরের সতর্কবার্তা যে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমছে।”

সতর্ক সংকেত পেলে কী করবেন?

অজ্ঞান হওয়ার আশঙ্কা বুঝতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. অখিল। তার পরামর্শ,

  • সম্ভব হলে শুয়ে পড়ুন এবং পা উঁচু করুন
  • অথবা বসে মাথা হাঁটুর মধ্যে রাখুন
  • আঁটসাঁট পোশাক ঢিলা করুন
  • ধীরে, গভীরভাবে শ্বাস নিন

এ ছাড়া পা ক্রস করে চেপে ধরা, হাত শক্ত করে ধরা বা স্ট্রেস বল চেপে ধরার মতো কাউন্টার-প্রেশার কৌশল রক্তচাপ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

অজ্ঞান হয়ে গেলে কী করবেন?

আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ডা. অখিলের পরামর্শ, জ্ঞান ফিরলে অন্তত ১০-১৫ মিনিট শুয়ে থাকতে হবে। মাথা বা শরীরে গুরুতর আঘাত লেগেছে কি না, পরীক্ষা করতে হবে। ধীরে ধীরে উঠে পানি পান করতে হবে।

ডা. অখিল বলেন, “বেশির ভাগ মানুষ দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন, তবে তাড়াতাড়ি দাঁড়ালে আবার অজ্ঞান হতে পারে।” তাছাড়া ডাক্তারের পরামর্শ না পাওয়া পর্যন্ত গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতেও বলেছেন তিনি।

ডা. অখিল জানান, ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ সাধারণত ক্ষতিকর নয়। তবে বারবার বা হঠাৎ অজ্ঞান হলে কারণ খুঁজে দেখা জরুরি। তা ছাড়া এটি প্রতিরোধের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। কিন্তু জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন কার্যকর হতে পারে। যেমন- নিয়মিত খাবার ও পানি পান, চিকিৎসকের পরামর্শে লবণ গ্রহণ, কমপ্রেশন স্টকিং ব্যবহার (কম্প্রেশন স্টকিংস হল বিশেষ ইলাস্টিক পোশাক যা সঞ্চালন উন্নত করতে এবং পা ফোলা কমাতে মৃদু চাপ প্রয়োগ করে), রক্ত বা চিকিৎসা পদ্ধতির ভয় থাকলে এক্সপোজার থেরাপি অনুশীলন করা যায়।

এক্সপোজার থেরাপি হলো কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপির একটি অংশ, যেখানে ধীরে ধীরে ভয়ের মুখোমুখি হওয়া শেখানো হয়।

কখন চিকিৎসা জরুরি?

অজ্ঞান হওয়া এক মিনিটের বেশি স্থায়ী হলে বা পড়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত পেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. অখিল নারাং বলেন, “বারবার অজ্ঞান হলে বা কোনো সতর্কতা ছাড়াই হলে অবশ্যই পরীক্ষা করা দরকার। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সচেতনতা, শিক্ষা ও যেসব ঘটনায় এমন প্রতিক্রিয়া হয় সেগুলো এড়ানোই সমস্যা কমাতে যথেষ্ট।”

সম্পর্কিত