কাজী সাজিদুল হক

গত শতকের ৮০ ও ৯০ এর দশকে শহরের বিশেষ করে ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে চাইনিজ খাবার মানেই বেশ অভিজাত একটা ব্যাপার। কিছু একটা উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তখনকার সময়ের বিনোদনের প্রায় একমাত্র মাধ্যম বিটিভিতে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁর বিজ্ঞাপন অনেকেরই মনে থাকার কথা। আর সেই সময় চাইনিজ খাবার মানেই দু ধরনের স্যুপের যেকোনো একটি, সঙ্গে অনথন বা স্প্রিং রোল। মেইন কোর্সে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন ফ্রাই। কখনো কখনো একটা সাদা সাদা ফ্যাকাশে সবজির কারি কিংবা চিলি চিকেন। অনেক সময় চপসুয়েও থাকত। সেটাকে আবার বলা হতো আমেরিকান চপসুয়ে। মূলত এই কয়েক পদের মধ্যে ঘুরে ফিরে চলত চাইনিজ খাবার বাছাইয়ের কাজ।

অবিভক্ত বাংলায় ‘চাইনিজ খাবার’-এর ইতিহাস কিন্তু আরও একটু পুরোনো। যে সময়টার কথা শুরুতে বলা হয়েছে তার চেয়ে অন্তত ৫০ বছর পুরোনোতো বলাই যায়।
তার আগে, চলুন আরও একটু পেছনে যাই। না, পঞ্চম শতাব্দীতে যখন ফা-হিয়েন মহাশয় তৎকালীন ভারতবর্ষে এসেছিলেন, অত পিছিয়ে যেতে হবে না। আরেকটু পরে। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ক্ষমতা দখল করল। একসময় ওয়ারেন হেস্টিংস হলেন গভর্নর (পরে গভর্নর জেনারেল)। এই সময় ইয়াং তাই চাও ওরফে টং অ্যাচিউ নামে এক ভদ্রলোক আসলেন চীন থেকে আজকের পশ্চিম বাংলায়। সালটা ১৭৭৮। ওয়ারেন হেস্টিংস হুগলি নদীর ধারে বজবজ টাউনের কাছে এক জায়গায় আখ চাষ এবং চিনি উৎপাদনের জন্য টং অ্যাচিউকে অনুমতি দিলেন। টং অ্যাচিউ ছিলেন চীনের মানুষ। করতে আসলেন চিনির কারবার। চীন-চীনা-চিনি; সংযোগটা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়। এই অ্যাচিউ সাহেবের নামেই পরে জায়গাটার নাম হয় অছিপুর। টং সাহেবের সঙ্গে চীন থেকে আরও বেশ কিছু মানুষ আসলেন। অ্যাচিউ সাহেবের চিনি কল খুব একটা ভালো চলেনি। লোকসানে পড়তে হলো তাকে। বন্ধ হলো চিনি কল। কিন্তু তার সঙ্গে আসা চৈনিক জনগোষ্ঠী তখন কলকাতায় চলে গেলেন। তারা শুরু করলেন নানারকম ব্যবসা। যার মধ্যে ছিল চামড়ার ব্যবসাও।

আজকের কলকাতার টেরিটি বাজারে ছিল প্রথম চীনা পট্টি। ছিল বললে ভুল হবে, এখনও আছে। সেই ঔপনিবেশিক আমলেই একসময় শহরের কেন্দ্রে ট্যানারি থাকাটা সাহেবদেও আর পছন্দ হল না। তাদের সরিয়ে দেওয়া হল ট্যাংরা নামের এক জায়গায়। যেখানে চীনাদের বড় বসতি আছে এখন। আছে প্রচুর রেস্তোরাঁ। কলকাতায় আমার পরিচিত অনেককেই বলতে শুনেছি তাদের কম বয়সে তারা পান করার জন্য ট্যাংরায় যেতেন। কলকাতাবাসীর একটা আবেগও আছে ট্যাংরা নিয়ে।

তো, বিভিন্ন কাজে চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এলেন বাংলায়। যুক্ত হলেন বিভিন্ন পেশায়। নিজেদের সামাজিক মেলামেশার জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন ক্লাব। যেগুলোকে বলা হতো ‘হুইগুয়ান’। নতুন কেউ কলকাতায় এলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করত স্ব স্ব এলাকার মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা হুইগুয়ান। কেউ মারা গেলে তাদের শেষকৃত্যের ব্যবস্থাও হতো হুইগুয়ানের মাধ্যমে। থাকত একটা প্রার্থনা কক্ষ। বিভিন্ন উপলক্ষে মানুষ যেখানে জড়ো হতো। আর মানুষ জড়ো হওয়া মানেই সেখানে খাবার থাকবে। আর আড্ডা যেখানে হচ্ছে সেখানে খাবার না থাকাটা অস্বাভাবিক। ওই হুইগুয়ানগুলোতে কী কী খাবার পাওয়া যেতো সে সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। তবে এর ধারাবাহিকতায় শহর কলকাতায় ১৯২৪ সালে প্রথম চাইনিজ খাবারের রেস্তোরাঁ চালু হল।

‘নান কিং’ নামের দোকানটির মালিক ছিলেন ক্যান্টনিজ। প্রথমে শুধু চীনা মানুষেরাই সেখানে খেতে যেতেন এবং তাদের জন্যই খাবার তৈরি করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার অধিবাসীদের ওই ‘কাঁচা কাঁচা’ ‘স্বাদবিহীন’ খাবার ভালো লাগার কথা নয়। ব্যবসা পড়তির দিকে গেল। হয়তো ওই সময়টাতেই অসামান্য কিছু চীনা বাবুর্চি তৈরি করলেন আমাদের পরিচিত চাইনিজ খাবার। যাকে মূলত ইন্দো-চাইনিজ খাবার বলাই শ্রেয়। খাবারে পড়ল নানা স্থানীয় মসলা, মরিচ আর নানা পদের চাইনিজ সস। আর এভাবেই একের পর তৈরি হতে লাগল নতুন নতুন খাবার। যেমন চিলি চিকেন, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, মানচাও স্যুপ। এসবই কিন্তু ইন্দো-চাইনিজ খাবার।

ধরা যাক, মাঞ্চুরিয়ান চিকেন বা চিকেন মাঞ্চুরিয়ান। অনেকে বলেন, এই খাবারটির উৎপত্তি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। নেলসন ওয়াং নামের এক চীনা বাবুর্চি এই খাবার বানান। নেলসন সাহেবের জন্ম কলকাতায়। তিনি কাজ করতেন আজকের মুম্বাইয়ের ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ায়। একদিন কেউ তাকে বলেছিলেন প্রতিদিনকার খাবারের বাইরে নতুন কিছু বানাতে। নেলসন কী করলেন আদা কুচি, রসুন কুচি, কাঁচা মরিচ আর সোয়া সস, কর্ন স্টার্চ মিশিয়ে মুরগির একটা পদ তৈরি করলেন। ব্যস হয়ে গেলো চিকেন মাঞ্চুরিয়ান। এরপর আরও কত উদ্ভাবন।

বর্তমানে কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো চাইনিজ রেস্তোরাঁ হলো ইউ চু। ১৯২৭ সাল থেকে এই দোকানটি চলছে। এদের চিমনি স্যুপ আর জোসেফাইন নুডলসের বেশ সুনাম রয়েছে। আপনি যদি কলকাতার টেরিটি বাজার এলাকায় যান, তবে বেশ কয়েকটি সসের দোকান পাবেন। সেখানে গেলেও বোঝা যাবে চীনা খাবারে ভারতীয় প্রভাব। কিংবা ভারতীয় ও চীনা খাবারে যৌথ মিলমিশ সম্পর্কে। আপনি যদি ট্যাংরায় যান তবে দেখবেন সেখানে একটি ‘চাইনিজ কালী মন্দির’ আছে। এক চাইনিজ ভদ্রলোক এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন যিনি দেখভাল করেন তিনি তৃতীয় প্রজন্মের চেং ইয়ি শেং; ছিলেন বৌদ্ধ এখন হিন্দু। যদিও পূজা করেন একজন বাঙালি পুরোহিত। এই মন্দিরে পূজার প্রাসাদ হিসেবে নিরামিষ চাওমিন দেওয়া হয়। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, চাইনিজ বংশোদ্ভূতদের যারা কালী পূজা করেন তারা গরু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

সে যাক আমরা খাবারে থাকি। কলকাতার মতো ঢাকায় অত বড় চীনা বসতি গড়ে ওঠেনি সত্যি। তবে কিছু মানুষ ছিলেন। কেন যেন তারা কলকাতার মতো খাদ্য ব্যবসায় গেলেন না সেরকমভাবে। বাংলাপিডিয়া বলছে, ঢাকায় চীনা অভিবাসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঘটনা। গত শতকের চল্লিশের দশকে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তারা শহরের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করতেন। জুতা প্রস্তুতকারীরা বাস করতেন ইমামগঞ্জের মিটফোর্ড এলাকায় এবং এ অঞ্চলের রাস্তায় তাদের অনেক সারিবদ্ধ দোকান ছিল। আজিমপুরের চায়না বিল্ডিংয়ে বিভিন্ন পরিবার একসাথে বাস করত। এটি আমাদেরকে ঢাকায় তাদের অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চট্টগ্রামেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চীনা মানুষ ব্যবসা ও জুতা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ঢাকায় একসময় আফিম ব্যবসাও করতেন চীনারা।

১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে মি. মিং নামে এক ভদ্রলোক ঢাকার সেগুনবাগিচা রোডে ‘ক্যাফে চায়না’ নামে একটি রেস্তোরাঁ চালু করেন। এটাই সম্ভবত ঢাকায় প্রথম চাইনিজ খাবারের দোকান। ধীরে ধীরে এই ইন্দো-চাইনিজ খাবার জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ৬০-৬৫ সালের দিকে বিজয়নগরে গড়ে ওঠে ‘চাং ওয়া’, গুলিস্তানে ‘চু-চিন চাউ’, মধুমিতা সিনেমা হলের ওপরে ‘টাই টুং’ ছিল এক সময়কার জনপ্রিয় চাইনিজ খাবারের দোকান। ‘ক্যান্টন’ রেস্তেরাঁও বেশ জনপ্রিয় ছিলো। এই রেস্তোরাঁর কথা উঠে এসেছে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘ক্যান্টনে নিরিবিলি’ কবিতায়।
ঢাকা শহরের প্রায় সবগুলো চাইনিজ খাবারের দোকানের উপকরণের দিকে যদি তাকানো যায় তবে বোঝা যাবে সভ্যতার মিলমিশ কী করে হয়।

তবে মনে রাখতে হবে, ৮০ বা ৯০ এর দশকে কিংবা আজকের সময়ে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমরা যে ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন, বিফ চিলি বা অন্য কোনো ডিশ খাচ্ছি, তা বহু ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্যে গিয়েছে। তারপর আমাদের সামনে এসেছে।

গত শতকের ৮০ ও ৯০ এর দশকে শহরের বিশেষ করে ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে চাইনিজ খাবার মানেই বেশ অভিজাত একটা ব্যাপার। কিছু একটা উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তখনকার সময়ের বিনোদনের প্রায় একমাত্র মাধ্যম বিটিভিতে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁর বিজ্ঞাপন অনেকেরই মনে থাকার কথা। আর সেই সময় চাইনিজ খাবার মানেই দু ধরনের স্যুপের যেকোনো একটি, সঙ্গে অনথন বা স্প্রিং রোল। মেইন কোর্সে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন ফ্রাই। কখনো কখনো একটা সাদা সাদা ফ্যাকাশে সবজির কারি কিংবা চিলি চিকেন। অনেক সময় চপসুয়েও থাকত। সেটাকে আবার বলা হতো আমেরিকান চপসুয়ে। মূলত এই কয়েক পদের মধ্যে ঘুরে ফিরে চলত চাইনিজ খাবার বাছাইয়ের কাজ।

অবিভক্ত বাংলায় ‘চাইনিজ খাবার’-এর ইতিহাস কিন্তু আরও একটু পুরোনো। যে সময়টার কথা শুরুতে বলা হয়েছে তার চেয়ে অন্তত ৫০ বছর পুরোনোতো বলাই যায়।
তার আগে, চলুন আরও একটু পেছনে যাই। না, পঞ্চম শতাব্দীতে যখন ফা-হিয়েন মহাশয় তৎকালীন ভারতবর্ষে এসেছিলেন, অত পিছিয়ে যেতে হবে না। আরেকটু পরে। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ক্ষমতা দখল করল। একসময় ওয়ারেন হেস্টিংস হলেন গভর্নর (পরে গভর্নর জেনারেল)। এই সময় ইয়াং তাই চাও ওরফে টং অ্যাচিউ নামে এক ভদ্রলোক আসলেন চীন থেকে আজকের পশ্চিম বাংলায়। সালটা ১৭৭৮। ওয়ারেন হেস্টিংস হুগলি নদীর ধারে বজবজ টাউনের কাছে এক জায়গায় আখ চাষ এবং চিনি উৎপাদনের জন্য টং অ্যাচিউকে অনুমতি দিলেন। টং অ্যাচিউ ছিলেন চীনের মানুষ। করতে আসলেন চিনির কারবার। চীন-চীনা-চিনি; সংযোগটা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়। এই অ্যাচিউ সাহেবের নামেই পরে জায়গাটার নাম হয় অছিপুর। টং সাহেবের সঙ্গে চীন থেকে আরও বেশ কিছু মানুষ আসলেন। অ্যাচিউ সাহেবের চিনি কল খুব একটা ভালো চলেনি। লোকসানে পড়তে হলো তাকে। বন্ধ হলো চিনি কল। কিন্তু তার সঙ্গে আসা চৈনিক জনগোষ্ঠী তখন কলকাতায় চলে গেলেন। তারা শুরু করলেন নানারকম ব্যবসা। যার মধ্যে ছিল চামড়ার ব্যবসাও।

আজকের কলকাতার টেরিটি বাজারে ছিল প্রথম চীনা পট্টি। ছিল বললে ভুল হবে, এখনও আছে। সেই ঔপনিবেশিক আমলেই একসময় শহরের কেন্দ্রে ট্যানারি থাকাটা সাহেবদেও আর পছন্দ হল না। তাদের সরিয়ে দেওয়া হল ট্যাংরা নামের এক জায়গায়। যেখানে চীনাদের বড় বসতি আছে এখন। আছে প্রচুর রেস্তোরাঁ। কলকাতায় আমার পরিচিত অনেককেই বলতে শুনেছি তাদের কম বয়সে তারা পান করার জন্য ট্যাংরায় যেতেন। কলকাতাবাসীর একটা আবেগও আছে ট্যাংরা নিয়ে।

তো, বিভিন্ন কাজে চীনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এলেন বাংলায়। যুক্ত হলেন বিভিন্ন পেশায়। নিজেদের সামাজিক মেলামেশার জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন ক্লাব। যেগুলোকে বলা হতো ‘হুইগুয়ান’। নতুন কেউ কলকাতায় এলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করত স্ব স্ব এলাকার মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা হুইগুয়ান। কেউ মারা গেলে তাদের শেষকৃত্যের ব্যবস্থাও হতো হুইগুয়ানের মাধ্যমে। থাকত একটা প্রার্থনা কক্ষ। বিভিন্ন উপলক্ষে মানুষ যেখানে জড়ো হতো। আর মানুষ জড়ো হওয়া মানেই সেখানে খাবার থাকবে। আর আড্ডা যেখানে হচ্ছে সেখানে খাবার না থাকাটা অস্বাভাবিক। ওই হুইগুয়ানগুলোতে কী কী খাবার পাওয়া যেতো সে সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। তবে এর ধারাবাহিকতায় শহর কলকাতায় ১৯২৪ সালে প্রথম চাইনিজ খাবারের রেস্তোরাঁ চালু হল।

‘নান কিং’ নামের দোকানটির মালিক ছিলেন ক্যান্টনিজ। প্রথমে শুধু চীনা মানুষেরাই সেখানে খেতে যেতেন এবং তাদের জন্যই খাবার তৈরি করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার অধিবাসীদের ওই ‘কাঁচা কাঁচা’ ‘স্বাদবিহীন’ খাবার ভালো লাগার কথা নয়। ব্যবসা পড়তির দিকে গেল। হয়তো ওই সময়টাতেই অসামান্য কিছু চীনা বাবুর্চি তৈরি করলেন আমাদের পরিচিত চাইনিজ খাবার। যাকে মূলত ইন্দো-চাইনিজ খাবার বলাই শ্রেয়। খাবারে পড়ল নানা স্থানীয় মসলা, মরিচ আর নানা পদের চাইনিজ সস। আর এভাবেই একের পর তৈরি হতে লাগল নতুন নতুন খাবার। যেমন চিলি চিকেন, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, মানচাও স্যুপ। এসবই কিন্তু ইন্দো-চাইনিজ খাবার।

ধরা যাক, মাঞ্চুরিয়ান চিকেন বা চিকেন মাঞ্চুরিয়ান। অনেকে বলেন, এই খাবারটির উৎপত্তি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। নেলসন ওয়াং নামের এক চীনা বাবুর্চি এই খাবার বানান। নেলসন সাহেবের জন্ম কলকাতায়। তিনি কাজ করতেন আজকের মুম্বাইয়ের ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ায়। একদিন কেউ তাকে বলেছিলেন প্রতিদিনকার খাবারের বাইরে নতুন কিছু বানাতে। নেলসন কী করলেন আদা কুচি, রসুন কুচি, কাঁচা মরিচ আর সোয়া সস, কর্ন স্টার্চ মিশিয়ে মুরগির একটা পদ তৈরি করলেন। ব্যস হয়ে গেলো চিকেন মাঞ্চুরিয়ান। এরপর আরও কত উদ্ভাবন।

বর্তমানে কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো চাইনিজ রেস্তোরাঁ হলো ইউ চু। ১৯২৭ সাল থেকে এই দোকানটি চলছে। এদের চিমনি স্যুপ আর জোসেফাইন নুডলসের বেশ সুনাম রয়েছে। আপনি যদি কলকাতার টেরিটি বাজার এলাকায় যান, তবে বেশ কয়েকটি সসের দোকান পাবেন। সেখানে গেলেও বোঝা যাবে চীনা খাবারে ভারতীয় প্রভাব। কিংবা ভারতীয় ও চীনা খাবারে যৌথ মিলমিশ সম্পর্কে। আপনি যদি ট্যাংরায় যান তবে দেখবেন সেখানে একটি ‘চাইনিজ কালী মন্দির’ আছে। এক চাইনিজ ভদ্রলোক এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখন যিনি দেখভাল করেন তিনি তৃতীয় প্রজন্মের চেং ইয়ি শেং; ছিলেন বৌদ্ধ এখন হিন্দু। যদিও পূজা করেন একজন বাঙালি পুরোহিত। এই মন্দিরে পূজার প্রাসাদ হিসেবে নিরামিষ চাওমিন দেওয়া হয়। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, চাইনিজ বংশোদ্ভূতদের যারা কালী পূজা করেন তারা গরু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

সে যাক আমরা খাবারে থাকি। কলকাতার মতো ঢাকায় অত বড় চীনা বসতি গড়ে ওঠেনি সত্যি। তবে কিছু মানুষ ছিলেন। কেন যেন তারা কলকাতার মতো খাদ্য ব্যবসায় গেলেন না সেরকমভাবে। বাংলাপিডিয়া বলছে, ঢাকায় চীনা অভিবাসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঘটনা। গত শতকের চল্লিশের দশকে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তারা শহরের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বাস করতেন। জুতা প্রস্তুতকারীরা বাস করতেন ইমামগঞ্জের মিটফোর্ড এলাকায় এবং এ অঞ্চলের রাস্তায় তাদের অনেক সারিবদ্ধ দোকান ছিল। আজিমপুরের চায়না বিল্ডিংয়ে বিভিন্ন পরিবার একসাথে বাস করত। এটি আমাদেরকে ঢাকায় তাদের অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চট্টগ্রামেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চীনা মানুষ ব্যবসা ও জুতা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ঢাকায় একসময় আফিম ব্যবসাও করতেন চীনারা।

১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে মি. মিং নামে এক ভদ্রলোক ঢাকার সেগুনবাগিচা রোডে ‘ক্যাফে চায়না’ নামে একটি রেস্তোরাঁ চালু করেন। এটাই সম্ভবত ঢাকায় প্রথম চাইনিজ খাবারের দোকান। ধীরে ধীরে এই ইন্দো-চাইনিজ খাবার জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ৬০-৬৫ সালের দিকে বিজয়নগরে গড়ে ওঠে ‘চাং ওয়া’, গুলিস্তানে ‘চু-চিন চাউ’, মধুমিতা সিনেমা হলের ওপরে ‘টাই টুং’ ছিল এক সময়কার জনপ্রিয় চাইনিজ খাবারের দোকান। ‘ক্যান্টন’ রেস্তেরাঁও বেশ জনপ্রিয় ছিলো। এই রেস্তোরাঁর কথা উঠে এসেছে কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘ক্যান্টনে নিরিবিলি’ কবিতায়।
ঢাকা শহরের প্রায় সবগুলো চাইনিজ খাবারের দোকানের উপকরণের দিকে যদি তাকানো যায় তবে বোঝা যাবে সভ্যতার মিলমিশ কী করে হয়।

তবে মনে রাখতে হবে, ৮০ বা ৯০ এর দশকে কিংবা আজকের সময়ে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমরা যে ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন, বিফ চিলি বা অন্য কোনো ডিশ খাচ্ছি, তা বহু ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্যে গিয়েছে। তারপর আমাদের সামনে এসেছে।

চীন বর্তমানে তার সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বিতর্কিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর একটি নির্মাণ করছে। আর সেটি হলো ইয়ারলুং জাংবো নদের ওপর একটি বিশাল জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থা। এই প্রকল্পের প্রভাব ভারত ও বাংলাদেশের ওপর সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মানুষের জীবন ও পরিবেশের