সেভেন সিস্টার-এর কিন্তু একটা ভাইও আছে

সেভেন সিস্টার-এর কিন্তু একটা ভাইও আছে
কিছুকাল আগে এই সাত বোনের সংসারে প্রবেশ ঘটেছে তাদের একমাত্র ভাই সিকিম। ছবি: গুগল ম্যাপ

ইদানীং অনেকেই সোনার হরিণের বদলে আওয়াজ তুলছেন, ‘আমার সেভেন সিস্টার চাই, আমার সেভেন সিস্টার চাই!’ কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে, আবার কেউ হাওয়া গরম করতে। আরে বাবা, শুধু সেভেন সিস্টার কেন, এই সাত বোন চম্পার তো একটা ভাইও আছে! তাদের এখন আটজনের সংসার! দিল্লির ছাতার তলায় বর্তমানে দিব্যি সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। তাই আসুন একটু উঁকি মেরে দেখা যাক এই সাত বোন, এক ভাই বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘অষ্টলক্ষ্মী’র আঁতুর ঘরে।

ভারতের সেভেন সিস্টার নিয়ে ইদানীং বহু জলঘোলা হলেও আমরা অনেকেই জানি না আসলে মুরগির গলাটা কেমন! অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা এই সাত রাজ্যকে বলা হয় সেভেন সিস্টার। কিছুকাল আগে এই সাত বোনের সংসারে প্রবেশ ঘটেছে তাদের একমাত্র ভাই সিকিম। তবে মোদি সাহেব এই আট রাজ্যকেই ‘অষ্টলক্ষ্মী’ বলে বর্ণনা করেছেন তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’র জন্য। এই আট রাজ্যের মধ্যে অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিম চীন সীমান্তে অবস্থিত। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও মিজোরামের। আবার মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশের। এই আট রাজ্যের উন্নয়নে বহুকাল আগে গড়ে ওঠে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ডোনার’–ডেভেলপমেন্ট অব নর্থ ইস্ট রিজিওন। এই ডোনারের হাত ধরেই গত কয়েক দশক ধরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে নর্থ ইস্ট।

১৪০ কোটির দেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যগুলোর মোট জনসংখ্যা ৫ কোটির কাছাকাছি। কিন্তু ভারত সরকার প্রতি বছর এই ৫ কোটি মানুষের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ১০ শতাংশ খরচ করে। ফলে ব্যাপক উন্নতির মুখ দেখছে মোদির ‘অষ্টলক্ষ্মী’। নয়ের দশকে বামপন্থীদের সমর্থন নিয়ে এইচ ডি দেবগৌড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই উত্তর পূর্বাঞ্চলে উন্নয়নের বাড়তি গতি পরিলক্ষিত হয়। এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্রের ঝঙ্কারে প্রায় মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত নর্থ ইস্টে আজ দূরবীন দিয়েও জঙ্গিদের খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এককালের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই এখন শান্তির বাণী প্রচার করছেন। তারাই এখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সামিল হয়ে উন্নয়নের গতিকে আরও দ্রুততর করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

অথচ, উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে এক সময় জঙ্গিদের রমরমা দাপট ছিল। যেমন মিজোরাম। লালডেঙার হাত ধরে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কয়েক দশক গেরিলা যুদ্ধে মত্ত ছিল। কিন্তু তারা এখন আত্মসমর্পণ করে মিজোরামের শান্তিরক্ষায় ব্যস্ত। এমএনএফ ক্যাডারদের অনেকে মিজো পুলিশে নিযুক্ত। শান্তি ফিরেছে। মিজোরাম তাই পাচ্ছে বিশেষ শান্তি বোনাস। নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ ও মণিপুরের কিছু অংশে বহুকাল দাপিয়ে বেড়িয়েছে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড বা এনএসসিএন। এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সকলেই এখন শান্তি প্রক্রিয়ার শরিক। ভারত সরকারের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। চলছে যুদ্ধবিরতিও। দলের অবিসংবাদিত নেতা থুইবাংলেং মুইভার বয়স এখন ৯১। তিনি সরকারি আতিথেয়তায় দিব্যি আছেন। ভালোই আছেন তার কমরেডরাও। ফলে নতুন করে লড়াই করার সাধ ও সাধ্য তাদের আর নেই।

ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম, সংক্ষেপে আলফা বা উলফা। এক সময় স্বাধীন আসামের স্বপ্ন ফেরি করে বেশ দাপট দেখিয়েছিল। বিদেশের মাটিতে বসে স্বাধীন আসামের স্বপ্ন ফেরি করে দেশ-বিদেশের বাহবাও কুড়িয়েছিল প্রচুর। কিন্তু দলের প্রতিষ্ঠাতারা প্রায় সকলেই এখন ফিরে এসেছেন স্বাভাবিক জীবনে। শুধু দু-একজন সঙ্গীকে নিয়ে শিবরাত্রির সলতের মতো টিকে আছেন তাদের স্বঘোষিত কমান্ডার-ইন-চিফ পরেশ বড়ুয়া। তার বয়স এখন ৬৮ বছর। দলের চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। আসামে অসমিয়াদের বাদ দিলে বোড়োদেরও এক সময় বেশ রমরমা ছিল। কিন্তু কালের নিয়মে অস্ত্র ছেড়ে তারাও এখন সামিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের লড়াইতে।

ন্যাশনালিস্ট লিবারেশন ফ্রন্ট অব তুইপ্রা (এনএলএফটি) এবং অল তুইপ্রা টাইগার ফোর্স (এটিটিএফ) স্বাধীন ত্রিপুরা বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাঙালি নিধন চালাচ্ছিল কিছুদিন আগেও। তারও আগে ছিল ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলেন্টিয়ার্স বা টিএনভি। এরা সবাই এখন জঙ্গল ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। বুঝে গিয়েছে, এ লড়াই অসম। ভারত সরকারও তাদের দুর্বলতা বুঝে পুনর্বাসন প্যাকেজের মাধ্যমে তাদের আরও দুর্বল করে দিয়েছে। এখন মণিপুর বা অন্যান্য জায়গায় সন্ত্রাস থাকলেও বিচ্ছিন্নতাবাদ নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে সেগুলো কাগজে-কলমে, বিবৃতিতে। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছে বাঙালিরা। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে মুসলিম বাঙালিদের নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। হিন্দুরাও অবশ্য বাদ যায়নি। তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে।

এটা ঠিক, মণিপুর এখনো অশান্ত। কিন্তু সেই অশান্তির কারণ একান্তই ঘরোয়া। কুকি ও মেইতেই–দুই সম্প্রদায়ের ঝগড়া। এখানে বাইরের ইন্ধন রয়েছে ঠিকই। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো স্লোগান নেই। মূল দাবি রাজ্যভাগের। কুকিরা চাইছেন ভারতের আরও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হতে। আর মেইতেইরা চাইছেন অখণ্ড মণিপুর রাজ্য। তাই সংঘর্ষ।

ভারতের সিকিম রাজ্য। ছবি: রয়টার্স
ভারতের সিকিম রাজ্য। ছবি: রয়টার্স

জনজাতি অধ্যুষিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ব্রিটিশদের সময় থেকেই ভারতের মূল ভূখণ্ডের মতো উন্নয়নের সুবিধা পায়নি, এটা বাস্তব। কিন্তু বর্তমানে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে এই অঞ্চলে। পাহাড়ি দূর্গমতাকে জয় করে ব্রডগেজ রেললাইন ছুটে চলেছে প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীর দিকে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যগুলোর উন্নয়ন আজ চোখে পড়ার মতো। জনজাতিরা সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের জীবন ও জীবিকাকে পাল্টে নিয়েছে। এই অবস্থায় নতুন করে বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ রোপণ করা সুবিধাজনক বলে মনে হয় না।

শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই নয়, মিয়ানমার সীমান্তেও কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে ভারত। থাকছে বিএসএফ ছাড়াও অন্যান্য আধা-সেনাদের টহল। গোয়েন্দা তৎপরতাও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এখন বেশ ভালো। জঙ্গি দমনেও পারদর্শী এখানকার পুলিশ। ফলে নতুন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী জিগির তোলা আজ আর সম্ভব বলে মনে হয় না। মানুষ আগের থেকে ভালো আছে। প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের সঠিক ব্যবহার চিরকালীন বঞ্চনার অভিযোগ থেকে মুক্ত করেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে। এখানকার মানুষও এখন মূলস্রোতের সঙ্গে রয়েছে।

চীন, মিয়ানমার, ভূটান, নেপাল ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের সামরিক শক্তিও কিন্তু কম নয়। শক্তিশালী ইস্টার্ন কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে সেনাবাহিনীর জাল বিস্তৃত। মাথায় রাখতে হবে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডও কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম যেমন স্থলবাহিনীর সদর দপ্তর, তেমনি মেঘালয়ের শিলং হচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় এয়ারফোর্সের হেড কোয়ার্টার। ফলে ‘সেভেন সিস্টার, সেভেন সিস্টার’ বলে চেঁচিয়ে বাজার গরম করা যেতেই পারে। কিন্তু বাস্তবে পরমাণু শক্তিধর ভারতের সেভেন সিস্টার বেশ শক্ত বুনিয়াদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত, এটাও মাথায় রাখা জরুরি।

তরুণ চক্রবর্তী: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলকাতা (ভারত)

সম্পর্কিত