এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে গেলে ক্ষতি কী?

এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে গেলে ক্ষতি কী?
এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি আগামী নির্বাচনে এককভাবে না জোট বেঁধে নির্বাচন করবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। একক হলে হলে তো কোনো কথাই নেই। জোটে গেলে দুখান কথা আছে। তারা বর্তমানে দুই বড় দল বিএনপি না জামায়াতের সঙ্গে যাবে? বিএনপির সঙ্গে গেলে কোনো কথা নেই; তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গেলে দুটো কথা বলতেই হবে। কারণ ইতিমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠে গেছে।

চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ছাত্রদের প্রথম সংগঠন ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নামটা শুনতে বেশ ভালো। কারণ আমরা সবাই চাই সাম্য। জীবন থেকে শুরু করে সমাজ কাঠামোতে পর্যন্ত। সাম্য চাইলে তো বৈষম্য থাকতে পারে না। বৈষম্যহীন একটা জীবন, একটা সমাজ, একটা দেশ–ভাবতেই রক্তে উত্তেজনার জোয়ার বইতে শুরু করে।

জোয়ারে আবার ভাটার টান আসতে সময় লাগে না। অমাবস্যা-পূর্ণিমার লীলা বোঝাই ভার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা অতি সহজেই নিজেদের ক্ষমতার জালে আটকে ফেলায় কেউ কেউ প্রফুল্ল হলেও অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। সেই সন্দেহ কতটা যথার্থ ছিল তা আজ বোঝা যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা নতুন দল করলেন–জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। এর নিবন্ধন বা প্রতীক-প্রত্যাশা নিয়ে কম নাটক হয়নি। কিন্তু এর সবটাই বাহ্যিক। সাধারণ মানুষের কাছে এ দুটোরই তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। এটা শুধু আইনি লৌকিকতা মাত্র।

এটাই বোধহয়, এনসিপি নেতারা বোঝেননি। তাই লৌকিকতায় অনেক সময় ও কথা ব্যয় করে ফেলেছেন। এই সময়টা সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় করলে তারা সমাজের অনেক হাঁড়ির-নাড়ির খবর পেতেন। তাহলে হয়তো জুলাই সনদ নিয়ে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করতেন না। জুলাই সনদ তৈরি হয়েছে ঠিকই, সেখানে ভোটের অধিকার, স্বৈরাচার ফিরে না আসার প্রত্যয়, একচেটিয়া ক্ষমতা না থাকার প্রতিশ্রুতিসহ অনেক কিছু আছে। তবে সেখানে ভাতের অধিকার কোথায়, শিক্ষার মৌলিক অধিকার কোথায়, কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি কোথায়, মানুষের নিশ্চিত মাথার গোজার প্রত্যয় কোথায়? নেই। নেই, বলেই এতসব প্রশ্ন উঠতে পেরেছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ১৫ মাস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সরকার চালানোর জন্য এই সময়টা একেবারে ফেলনা নয়। এই সময়কালে জিনিসপত্রে দাম কতটা বেড়েছে, কত কর্মসংস্থান হয়েছে, কতজন মানুষ ন্যয়বিচার পেয়েছেন–যার অপেক্ষায় তারা ছিলেন? এই প্রশ্নগুলো এনসিপির কোনো নেতার মুখে শুনিনি। অথচ, এগুলোই জোরোশোরে উঠে আসবে বলে আপামর দেশবাসী আশা করেছিল। দেশের একজন মানুষেরও আধাপেটা বা অভূক্ত থাকার চেয়ে বড় বৈষম্য কী আর কিছু আছে? এই বৈষম্য দূর করার জন্যই তো রাষ্ট্র এবং সরকার। পরিসংখ্যান বলছে, মানুষ দরিদ্র হচ্ছে। আর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়লেই টান পড়ে পেটে। তাহলে পেটের মীমাংসা না করে ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ নিয়ে আহ্লাদ দেখালে তা ওই মানুষগুলোর কাছে ঝলসানো রুটি বলেই মনে হবে।

এনসিপি নেতাদের উদ্দেশে এত কথা (অভিযোগ বলাই ভালো) বলার কারণ তাদের কাছে প্রত্যাশাটা ছিল বিপুল। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ দেখে আসছে। এনসিপি সেই গড্ডল প্রবাহে গা না ভাসিয়ে একটি বিপরীত স্রোতধারা তৈরি করবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ফারাক দিনে দিনে এতটা বাড়বে তা হয়তো আমাদের মতো অনেকেই ভাবতে পারেনি।

ভোটের তারিখ এগিয়ে আসতেই এনসিপির সেই সাবেকি রাজনীতির ধারায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পথ যেন পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে। ছাব্বিশের নির্বাচনে তারা দুই বড় দলের কারো একটির লেজুড় হতে চায়। কেন? কয়েকটা আসনের জন্য? এই নির্বাচনে আসন পেলে কী পাঁচ বছরে তারা হারিয়ে যাবেন–এই আশঙ্কা ভর করেছে এনসিপির নেতাদের মধ্যে? ছাত্রদের মধ্য থেকে এনসিপির জন্ম, অথচ চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তারা একেবারেই কিচ্ছু করতে পারেনি। তাই বলে কী লজ্জায় দলটা উঠে গেছে? তাতো যায়নি। তাহলে আগামী জাতীয় সংসদে তাদের কোনো প্রতিনিধি না থাকলে সমস্যাটা কোথায়? মানুষের কাছে যাওয়ার, মানুষের কথা বলার হাজারো পদ্ধতি আছে। সংসদ তারই মধ্যে একটা। অতীতে এ দেশের অধিকাংশ দলেরই জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল না, তাই বলে কী তারা মুছে গেছে? তাদের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে? বরং ক্ষেত্র বিশেষে সংসদে না থাকাটা সুবিধাজনকও হয়।

ফলে ক্ষমতার অন্দরে ঢোকার জন্য এতটা উদ্রগ্রীব থাকাটা মানুষের কাছে অন্য বার্তা দেয়। সবাই জানে ক্ষমতার প্রতিটি অলিন্দে মধু আছে। সেই মধুর স্বাদ সরকারি দলের সদস্যরা বেশি পান, বিরোধীরা কম হলেও কিছুতো পান। সেজন্য যেকোনো মূল্যে সংসদে যেতে হবে, এটা একটা নবীন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

এবার আশা যাক, শিরোনামের ভাষ্যে। দেশের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দল বিএনপি দীর্ঘ দিন ধরে ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। তারা প্রথমেই ২৩৭ জন (৩০০-র মধ্যে) প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, শরিকদের জন্য খুব বেশি আসন তারা দিতে পারবে না। বাস্তবিকই, না পারার কথা। গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতারা কোনো সুযোগই পাননি। আর এবার আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচন। তাই বিএনপির অনেক নেতাই ধরে নিয়েছেন, দলীয় মনোনয়ন পাওয়া মানে ভোটে নিশ্চিত জয়। স্বাভাবিকভাবে দলীয় নেতৃত্বের ওপর এই চাপটা আছেই। সে কারণে এনসিপিকে তাদের চাহিদা মতো আসন ছাড়তে পারেনি বিএনপি। এতে জোট গঠনের উদ্যোগও ভেস্তে গেছে।

বাকি ছিল জামায়াতে ইসলামী। দল হিসেবে তারা হয়তো তিন শ আসনে প্রার্থী দিতে পারবে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কতটুকু হবে–এটা বিরাট প্রশ্ন। ফলে শরিকদের তারা সন্তুষ্ট করেই আসন সমঝোতা করতে সমর্থ। এনসিপি কী তাহলে সেই সুযোগ নিচ্ছে? নিলে দোষের কী? দোষ আছে। জামায়াতের জোটে গেলে এনসিপির মতো নতুন দলের গায়ে ‘ডানপন্থী’ বিশেষণ যুক্ত হতে পারে। জন্মলগ্ন থেকে, বিশেষ করে প্রথম নির্বাচন থেকে এই বিশেষণ তাদের জন্য খুব সুবিধার না-ও হতে পারে। কারণ এনসিপির অনেক নেতা সাম্প্রতিক অতীতে এমন সব বক্তব্য রেখেছেন, তাতে জামায়াতের সাথে জোট বাঁধাটা ঠিক যায় না।

তবে ২০০১ সালের আগে থেকে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী সঙ্গে জোট করেও মধ্য-ডানপন্থী দল হিসেবে নিজের পরিচয় ধরে রাখতে পারলে এনসিপির সমস্যা কোথায়? কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও একটি ছোট সমস্যা আছে। সে সমস্যা হলো, এনসিপিকে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে দেখার প্রত্যাশা। ভারতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি প্রাথমিকভাবে এটা পারলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি তা পারবে না কেন? সাম্প্রতিক না দূরবর্তী কোন ফলটা তারা চান, তা ঠিক করতে পারলে এ প্রশ্নের মিমাংসা সম্ভব।

লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, চরচা।

সম্পর্কিত