ইউক্রেন: পুতিন দক্ষতার সঙ্গে ট্রাম্পকে খেলাচ্ছেন

স্টেফান উলফ
স্টেফান উলফতেতিয়ান মালিয়ারেনকো
ইউক্রেন: পুতিন দক্ষতার সঙ্গে ট্রাম্পকে খেলাচ্ছেন
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

গত সপ্তাহে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও রাশিয়ার ইউক্রেনবিরোধী যুদ্ধ নিয়ে নিজের অবস্থান ঘুরিয়ে ফেললেন। এটি এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এক পরিচিত আচরণের ধরন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি রাগ ও হতাশা প্রকাশ করেন, তারপর ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত-সাধারণত পুতিনের সঙ্গে কোনো ফোনালাপের পরই তিনি আবার এমন কোনো ‘ইতিবাচক দিক’ খুঁজে পান যা কেবল তার নিজের মতে যৌক্তিক এবং তাতে তিনি পুতিনের ছন্দে নাচতে শুরু করেন।

এই পূর্বানুমেয় নাটকের সর্বশেষ পর্বটি ঘটেছে এভাবে। সেপ্টেম্বরে যখন ট্রাম্প (এখনো) ব্যর্থভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নিজেকে প্রার্থী করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন, তখন তিনি ইউক্রেনের সম্ভাব্য বিজয়ের কথা বলতে শুরু করেন। তার মতে, ইউক্রেনের জয় মানে, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে রাশিয়ার দখলে যাওয়া সব ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য হঠাৎই আলোচনায় আসে ইউক্রেনকে মার্কিন টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি ও জ্বালানি স্থাপনায় আঘাত হানার ক্ষমতা দিত। যা এখন পর্যন্ত তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে নেই। ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ১১ ও ১২ অক্টোবর দুবার ফোনে কথা বলেন এ নিয়ে। ১৭ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে বৈঠকের পর একটি চুক্তি ঘোষণা আসার কথা ছিল।

কিন্তু বৈঠকের আগের দিনই (ক্রেমলিনের অনুরোধে বলে মনে করা হয়) ট্রাম্প পুতিনের ফোন রিসিভ করেন। দুই ঘণ্টার সেই কথোপকথনে পুতিন প্রশংসা ও বাণিজ্য পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্পকে রাজি করান ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র না দেওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে আসতে।

পরদিন ঝেলেনস্কির নেতৃত্বাধীন ইউক্রেনীয় প্রতিনিধি দলকে এ কথা জানানো হয়। যদিও এটি গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে তাদের প্রথম বৈঠকের মতো অপমানজনক ছিল না। তবু ইউক্রেনের জন্য এটি স্পষ্ট এক ধরনের পরাজয়।

শুধু টমাহকই নয়, কিয়েভ ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আবারও আগের জায়গায় ফিরে গেছে। আসলে যেখানে পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে একটি ‘চুক্তির সম্ভাবনা’ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এমনকি শোনা যাচ্ছে, কর্মকর্তারা আগে থেকে দুটি আলাদা চুক্তির খসড়া তৈরি করবেন। যেগুলো শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প-পুতিনের আরেক বৈঠকে (সম্ভবত বুদাপেস্টে) চূড়ান্ত হবে।

প্রথম হবে শান্তি চুক্তির সাধারণ কাঠামো নিয়ে। বৈঠকের পর ট্রাম্প নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের উচিত বর্তমান অবস্থান মেনে নিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করা।’ অর্থাৎ, ট্রাম্প এমন এক সমঝোতার ভিত্তিতে আবারও যুদ্ধ থামাতে আগ্রহী যেখানে ইউক্রেনকে তার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভূখণ্ডের প্রায় ২০% হারাতে হবে। যা ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

দ্বিতীয় চুক্তি হবে ওয়াশিংটন-মস্কোর সম্পর্ক পুনর্গঠন নিয়ে। এটি দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্পের লক্ষ্য। এর মানে হলো রাশিয়া, এমনকি তার সহযোগী দেশ ভারত ও চীনের বিরুদ্ধে নতুন কোনো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আপাতত আসছে না।

ঝেলেনস্কির ওয়াশিংটন সফরের আগে নভেম্বরেই যুদ্ধবিরতির আশা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প-পুতিনের আলোচনায় যুদ্ধবিরতির কোনো উল্লেখ নেই। বরং যুদ্ধ থামানোকে নির্ভরশীল করছে ট্রাম্প ও পুতিন– এই দুই প্রেসিডেন্টের চুক্তির ওপর। যা ঝেলেনস্কিকে পরে মেনে নিতে হবে।

এর ফলে ইউক্রেনের ওপর চাপ আরও বাড়বে। দেশটি প্রতিদিনই রাশিয়ার হামলায় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হারাচ্ছে। যা অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। সামনে আরও একটি কঠিন শীতের ইঙ্গিত মিলছে।

নভেম্বরেই যুদ্ধবিরতির আশা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প-পুতিনের আলোচনায় যুদ্ধবিরতির কোনো উল্লেখ নেই। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
নভেম্বরেই যুদ্ধবিরতির আশা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প-পুতিনের আলোচনায় যুদ্ধবিরতির কোনো উল্লেখ নেই। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

রাশিয়ার কৌশল সময় ক্ষেপণ

ইউক্রেনের জন্য পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে প্রতিকূল। তবে এটি কেবল ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনার ফল নয়। সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প যখন যুদ্ধ নিয়ে নিজের অবস্থান বদলাতে শুরু করেন, তখন থেকেই ক্রেমলিন পরিকল্পিতভাবে দুই প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার দিকে এগোয়। আর এই এগোনোর পথে ছিল উদ্বেগ, হুমকি ও চাটুকারিতার এক মিশ্রণ।

এই ঘনিষ্ঠতার লক্ষ্য রাশিয়ার জন্য কোনো ‘ভালো শান্তি চুক্তি’ নয়; পুতিনও জানেন সেটা অবাস্তব। মূল উদ্দেশ্য ছিল সময় ক্ষেপণ, যাতে রাশিয়া দোনবাস অঞ্চলে স্থলযুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে।

এক্ষেত্রে সম্ভাব্য ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের স্থান হিসেবে বুদাপেস্টকে বেছে নেওয়াটাও তাৎপর্যপূর্ণ। পুতিনকে সেখানে যেতে হলে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য বা প্রার্থী দেশগুলোর আকাশসীমা পেরোতে হবে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর ওপর চাপ পড়বে। তারা যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে ট্রাম্পের ‘শান্তি উদ্যোগে বাধা’ হিসেবে দেখা হবে। ক্রেমলিন বহুদিন ধরেই এই কথা ছড়াচ্ছে, যা ন্যাটোর ঐক্য দুর্বল করার অংশ।

অন্যদিকে, ট্রাম্পের এই নতুন অবস্থান যতই ইউক্রেনের জন্য হতাশাজনক হোক, তা তাদের পরাজয়ের ইঙ্গিত নয়। ইউক্রেনে এখন পূর্ণমাত্রায় সেনা সমাবেশ চলছে। দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন বাড়ছে। ন্যাটোর অর্ধেকেরও বেশি দেশ ইউক্রেনকে আরও মার্কিন অস্ত্র দিতে সম্মত হয়েছে।

সাম্প্রতিক কূটনৈতিক অস্থিরতা থেকে তিনটি শিক্ষা

প্রথমত, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার সম্ভাবনার খবরই রাশিয়ার ভেতরে একপ্রকার ভীতির সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে পুতিন নিজে ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এটি রাশিয়ার দুর্বলতারই প্রমাণ।

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প ইউক্রেন বা ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য নির্ভরযোগ্য বন্ধু নন। তিনি এখনো ইউএস-রাশিয়া গোপন চুক্তির চিন্তা ছাড়েননি। এটা হলে ইউক্রেন ও ইউরোপের ক্ষতির বিনিময়ে হতে পারে।

তৃতীয়ত, ঝেলেনস্কি এই ব্যর্থ বৈঠকের পর হতাশ হলেও ইউক্রেন এখনো খেলায় আছে। ট্রাম্প যেমন বলেছিলেন, রাশিয়া অনেকটাই ‘কাগুজে বাঘ’, আর ইউক্রেনের জেতার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়নি। অন্তত গ্রহণযোগ্য এক সমঝোতায় পৌঁছানোর মতো শক্তি ইউক্রেনের আছে।

তবে শেষ পর্যন্ত ইউরোপ যদি আরও দৃঢ়ভাবে না এগোয়, তাহলে এই যুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাবিকাঠি রয়ে যাবে হোয়াইট হাউসের হাতেই।

স্টেফান উলফ: আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম

তেতিয়ান মালিয়ারেনকো: আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও ইউরোপীয় নিরাপত্তার জ্যাঁ মোনে অধ্যাপক, ওডেসা ল’ একাডেমি, ইউক্রেন

(লেখাটি দ্য কনভারসেশন ডট কমের সৌজন্যে প্রকাশিত হলো)

সম্পর্কিত