সুদীপ্ত সালাম
আগুন দেওয়ার অনেক পরে—রাত ১টার দিকে পৌঁছাই কারওয়ান বাজারে। তখনো প্রথম আলোর ছোট্ট সাদা ভবনটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। গনগনে আগুন ছাড়া আর কোনো আলো নেই। নিরুদ্দেশ চাঁদ। ভবনটির নিচের তলায় থাকা বইয়ের দোকানটিও বাদ যায়নি, বইগুলো সড়কে স্তুপ করে পোড়ানো হয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে র্যাব ও পুলিশের কিছু সদস্য। ভবনের সামনে ‘বিক্ষুদ্ধ জনতা’—তারা একটু পরপর স্লোগান দিচ্ছে ‘নারায়ে তাকবির! আল্লাহু আকবার!’ ‘নারায়ে তাকবির! আল্লাহু আকবার!’ তাদের ক্ষোভ তখনো ভবনের আগুনের মতোই জ্বলছে, আগুনের কবলে থাকা ভবনটিতে ছুড়ে মারছে ইট-পাটকেল। ছবি নিচ্ছি এমন সময় একজন আমার পিঠে চাপড় দিয়ে ডাকলেন, তার দিকে ফিরতেই জানালেন, “উল্টা-পাল্টা নিউজ কইরেন না কিন্তু, বুগিচুগি নিউজ করলে কী হয়—তা দেখবারই পারতাছেন”, কথাটি শেষ করেই তিনি তার হাতে থাকা রডটি দিয়ে প্রথম আলোর পুড়তে থাকা ভবনটি দেখিয়ে দিলেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম, আরেকটি পত্রিকার অফিসও তো জ্বলছে।
তার আগে রাত ১০টার দিকে খবর আসে ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান শরিফ হাদি সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মারা গেছেন। এই খবরে দৈনিক বাংলা মোড়ে আমাদের অফিসে হুলুস্থুল পড়ে যায়, মৃত্যু-সংবাদ নিশ্চিত করে নিউজ পাবলিশ করা, ফটোকার্ড বানানো—আরও কত কী! ওদিকে শাহবাগে শুরু হয়ে গেছে বিক্ষোভ সমাবেশ, টেলিভিশনে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ…। এসব সামাল দিতে দিতেই রাত ১২টা। তারপর ভীষণ ক্লান্ত নিজেকে টেনে বাসায় তুললাম। কেউ কিছু বলেনি—কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে মন পড়ে রইল কারওয়ান বাজার। আবার বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথম আলো রেখে ছুটে গেলাম ডেইলি স্টার ভবনের সামনে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কালো কাচে মোড়া বিশাল ভবনটি তার পেছনের গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। ভবনের মাথার দিকে শুভ্র ধোঁয়ার কুণ্ডলি। সবাই বলছে, দ্য ডেইলি স্টারের অনেক কর্মী ছাদে আটকে আছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা থাকায় এখানে ‘বিক্ষুদ্ধ জনতা’ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। তবে তাদের মন্তব্য থেমে নেই, ‘এইটা তো ডেইলি স্টার না, দিল্লি স্টার’, ‘ভারতের দালাল গো মাটিসহ উডাইয়া ফেলতে হইব’, ‘এরাই আওয়ামী লীগের দোসর’…। ভবনের সামনে যাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে না পারে, সেই চেষ্টা করেছে একটি দল। সেনাবাহিনী থাকায় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। তারা কাজে নেমে পড়েন। অ্যারিয়েল ল্যাডার দিয়ে ছাদ থেকে একজনকে নামিয়ে নিয়ে আসা হলো। চিনতে পারলাম, ছেলেটি ডেইলি স্টারের ক্যান্টিনে কাজ করে। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া। এর মধ্যে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাংবাদিক ও ইউটিউবাররা।

মনে হচ্ছিল এই রাত যেন ফুরাবার নয়। রাত ভোরের আলোর দিকে যায়, কিন্তু আজকের রাত যেন আরও অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো রাত দেখেই কি কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ’? রাত দুটোর দিকে হোয়াটস্যাপে একটি ম্যাসেজ আসে, “ছায়ানটে কি আগুন দেওয়া হয়েছে?” এমন পরিস্থিতিতে গুজবের ডালপালা ছড়াতে থাকে। হয়তো ছায়ানটে আগুন লাগার খবরটিও ভুয়া। কেননা, ওসমান হাদির মৃত্যুতে ছায়ানটে কেন আগুন দেওয়া হবে? কিন্তু প্রশ্নটির উত্তরও তো জানা চাই। দোটানায় পড়ে গেলাম, সংবাদ যদি সত্য হয়? যুক্তি দিয়ে কি আর সব হয়! শেষে ধানমন্ডির শঙ্করের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কথা সত্য। ছায়ানট ভবনেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ভেতরের বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম বাইরে এনে পোড়ানো হয়েছে। ভেতরের প্রায় প্রতিটি রুমের আসবাব ও জিনিসপত্র তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। আগুন লাগানো হয়েছে একাধিক ফ্লোরে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে স্বরলিপির খাতা, তবলা, হারমোনিয়াম, খেলনা…। তবে আগুন ছড়াতে পারেনি, তার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করেছে। ভবনের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বইপত্র। দেখলাম কবি নজরুলের টুপিপরা বড় ছবিটি ছাড়া বাকি সব ছবি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, বাদ যায়নি লালনের প্রতিকৃতিও।

রাত সাড়ে ৩টার দিকে ছায়ানট থেকে বের হই। শীতল ও সমাধিনীরব শহরের সুনসান সড়কে যেন আমি একা। পুরো শহরটাই যেন একটি হিমঘর—আমরা মরদেহ। এসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে ধীরগতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, বাড়িতে আমার উদ্বিগ্ন স্বজনরা আমার অপেক্ষায় নির্ঘাত জেগে আছে। আর তারাও কি নিরাপদে আছে? আমি মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে হিমঘরের হিম কেটে আপনজনদের কাছে ফিরতে লাগলাম।
সুদীপ্ত সালাম: প্রধান, ভিডিও বিভাগ, চরচা
আগুন দেওয়ার অনেক পরে—রাত ১টার দিকে পৌঁছাই কারওয়ান বাজারে। তখনো প্রথম আলোর ছোট্ট সাদা ভবনটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। গনগনে আগুন ছাড়া আর কোনো আলো নেই। নিরুদ্দেশ চাঁদ। ভবনটির নিচের তলায় থাকা বইয়ের দোকানটিও বাদ যায়নি, বইগুলো সড়কে স্তুপ করে পোড়ানো হয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে র্যাব ও পুলিশের কিছু সদস্য। ভবনের সামনে ‘বিক্ষুদ্ধ জনতা’—তারা একটু পরপর স্লোগান দিচ্ছে ‘নারায়ে তাকবির! আল্লাহু আকবার!’ ‘নারায়ে তাকবির! আল্লাহু আকবার!’ তাদের ক্ষোভ তখনো ভবনের আগুনের মতোই জ্বলছে, আগুনের কবলে থাকা ভবনটিতে ছুড়ে মারছে ইট-পাটকেল। ছবি নিচ্ছি এমন সময় একজন আমার পিঠে চাপড় দিয়ে ডাকলেন, তার দিকে ফিরতেই জানালেন, “উল্টা-পাল্টা নিউজ কইরেন না কিন্তু, বুগিচুগি নিউজ করলে কী হয়—তা দেখবারই পারতাছেন”, কথাটি শেষ করেই তিনি তার হাতে থাকা রডটি দিয়ে প্রথম আলোর পুড়তে থাকা ভবনটি দেখিয়ে দিলেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম, আরেকটি পত্রিকার অফিসও তো জ্বলছে।
তার আগে রাত ১০টার দিকে খবর আসে ইনকিলাব মঞ্চের ওসমান শরিফ হাদি সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মারা গেছেন। এই খবরে দৈনিক বাংলা মোড়ে আমাদের অফিসে হুলুস্থুল পড়ে যায়, মৃত্যু-সংবাদ নিশ্চিত করে নিউজ পাবলিশ করা, ফটোকার্ড বানানো—আরও কত কী! ওদিকে শাহবাগে শুরু হয়ে গেছে বিক্ষোভ সমাবেশ, টেলিভিশনে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ…। এসব সামাল দিতে দিতেই রাত ১২টা। তারপর ভীষণ ক্লান্ত নিজেকে টেনে বাসায় তুললাম। কেউ কিছু বলেনি—কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে মন পড়ে রইল কারওয়ান বাজার। আবার বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথম আলো রেখে ছুটে গেলাম ডেইলি স্টার ভবনের সামনে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কালো কাচে মোড়া বিশাল ভবনটি তার পেছনের গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। ভবনের মাথার দিকে শুভ্র ধোঁয়ার কুণ্ডলি। সবাই বলছে, দ্য ডেইলি স্টারের অনেক কর্মী ছাদে আটকে আছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা থাকায় এখানে ‘বিক্ষুদ্ধ জনতা’ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। তবে তাদের মন্তব্য থেমে নেই, ‘এইটা তো ডেইলি স্টার না, দিল্লি স্টার’, ‘ভারতের দালাল গো মাটিসহ উডাইয়া ফেলতে হইব’, ‘এরাই আওয়ামী লীগের দোসর’…। ভবনের সামনে যাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে না পারে, সেই চেষ্টা করেছে একটি দল। সেনাবাহিনী থাকায় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। তারা কাজে নেমে পড়েন। অ্যারিয়েল ল্যাডার দিয়ে ছাদ থেকে একজনকে নামিয়ে নিয়ে আসা হলো। চিনতে পারলাম, ছেলেটি ডেইলি স্টারের ক্যান্টিনে কাজ করে। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া। এর মধ্যে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাংবাদিক ও ইউটিউবাররা।

মনে হচ্ছিল এই রাত যেন ফুরাবার নয়। রাত ভোরের আলোর দিকে যায়, কিন্তু আজকের রাত যেন আরও অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো রাত দেখেই কি কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ’? রাত দুটোর দিকে হোয়াটস্যাপে একটি ম্যাসেজ আসে, “ছায়ানটে কি আগুন দেওয়া হয়েছে?” এমন পরিস্থিতিতে গুজবের ডালপালা ছড়াতে থাকে। হয়তো ছায়ানটে আগুন লাগার খবরটিও ভুয়া। কেননা, ওসমান হাদির মৃত্যুতে ছায়ানটে কেন আগুন দেওয়া হবে? কিন্তু প্রশ্নটির উত্তরও তো জানা চাই। দোটানায় পড়ে গেলাম, সংবাদ যদি সত্য হয়? যুক্তি দিয়ে কি আর সব হয়! শেষে ধানমন্ডির শঙ্করের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কথা সত্য। ছায়ানট ভবনেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ভেতরের বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম বাইরে এনে পোড়ানো হয়েছে। ভেতরের প্রায় প্রতিটি রুমের আসবাব ও জিনিসপত্র তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। আগুন লাগানো হয়েছে একাধিক ফ্লোরে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে স্বরলিপির খাতা, তবলা, হারমোনিয়াম, খেলনা…। তবে আগুন ছড়াতে পারেনি, তার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করেছে। ভবনের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বইপত্র। দেখলাম কবি নজরুলের টুপিপরা বড় ছবিটি ছাড়া বাকি সব ছবি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, বাদ যায়নি লালনের প্রতিকৃতিও।

রাত সাড়ে ৩টার দিকে ছায়ানট থেকে বের হই। শীতল ও সমাধিনীরব শহরের সুনসান সড়কে যেন আমি একা। পুরো শহরটাই যেন একটি হিমঘর—আমরা মরদেহ। এসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে ধীরগতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, বাড়িতে আমার উদ্বিগ্ন স্বজনরা আমার অপেক্ষায় নির্ঘাত জেগে আছে। আর তারাও কি নিরাপদে আছে? আমি মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে হিমঘরের হিম কেটে আপনজনদের কাছে ফিরতে লাগলাম।
সুদীপ্ত সালাম: প্রধান, ভিডিও বিভাগ, চরচা