১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশ ঘিরে কূটনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে

বাংলাদেশ ঘিরে কূটনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পতাকা। ছবি: উইকিপিডিয়া

বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকা কার্যত মুক্ত। একদিকে অস্থায়ী সরকার প্রশাসন পরিচালনার রূপরেখা তৈরি করছিল। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনী চূড়ান্ত বিজয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু বিজয়ের আগের এই দিনগুলোতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রশ্নে মূলত পরাশক্তিগুলো কূটনীতিক তৎপরতাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

১২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন শেষ চেষ্টা হিসেবে পাকিস্তানের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ অবিলম্বে বন্ধ করতে ভারতের প্রতি আহ্বান। যুদ্ধ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন বৈঠক ডাকারও অনুরোধ জানান। নিক্সন নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশে বলেন, এই লড়াই থামানোর জন্য জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। পূর্ব বাংলা ভারতীয় সেনারা প্রায় দখল করে নিয়েছে।

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার এক বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভারতের এই আক্রমণ জাতিসংঘের একটি সদস্যরাষ্ট্রের ওপরই আক্রমণ। বিষয়টি অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদে আনার জন্য নিক্সন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশকে নির্দেশ পাঠিয়েছেন। সকালে তিনি কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনা করে সে অনুযায়ীই অগ্রসর হচ্ছেন।

এদিন রাতে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক ডাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জোর চেষ্টা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ডের জোরালো দাবির মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে চীন সমর্থন জানিয়েছিল। অবশেষে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ১৩ ডিসেম্বর আবার বৈঠক শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত এল কে ঝা এদিন নিউইয়র্কে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলে ভারত অস্ত্র সংবরণে রাজি হতে পারে।

নিউইয়র্ক সফররত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলে এবং ভারতীয় এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনা সরিয়ে নিলে ভারত যুদ্ধবিরতি এবং সেনা অপসারণের প্রস্তাব বিবেচনা করবে।

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের হাইড পার্কে প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী বাঙালি এক সমাবেশে বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করে। সমাবেশে বক্তব্য দেন লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রেজাউল করিম, লেবার পার্টির সংসদ সদস্য পিটার শোর ও জন স্টোনহাউস এবং বাংলাদেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ নেতা আসহাব-উল হক জোয়ারদার। সমাবেশ শেষে প্রবাসী বাঙালিরা বিরাট মিছিল নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করতেও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়। পরদিন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই মিছিলকে ‘বিজয় সমারোহ’ বলে অভিহিত করা হয়।

লন্ডনের মহাত্মা গান্ধী হলে ইন্ডিয়া লিগ আয়োজিত এক সভায় লেবার পার্টির সাবেক মন্ত্রী পিটার শোর বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং ব্যবহারিক সাহায্য দিতে যুক্তরাজ্যের তৈরি থাকা উচিত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে এক জনসভায় চলমান ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে বলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তি যেন কাজে লাগানোর চেষ্টা না করা হয়।

ইন্দিরা গান্ধী এদিন জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, পাকিস্তান পূর্ববঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যাদের আনুগত্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে আপসরফা করে, তাহলে তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি আছেন।

দিল্লি ও মুজিবনগরের সূত্রগুলো এদিন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে। এ খবরে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন এদিন ইসলামাবাদে পাকিস্তানে নিয়োজিত চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন। উপমহাদেশে যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে চীনা সরকারকে জানাতে তিনি চীনা রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান। নুরুল আমিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন।

ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হওয়ার আগে ভারতীয় বাহিনীর ছত্রীসেনারা আশপাশের কিছু এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় অবতরণ করে। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চলছিল। ভৈরব বাজার থেকে যৌথ বাহিনী এদিন নরসিংদীতে এসে পৌঁছায়। ঢাকা মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরে। আগের দিন যারা ময়মনসিংহ দখল কয়েছিল, তারাও ক্রমেই ঢাকার দিকে আসতে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে হেলিকপ্টারে অবতরণকারী সেনা। হেলিকপ্টার এসেছে মেঘনা ও যমুনা দ্রুত পার হয়ে যেতে। যৌথ বাহিনীর বেশ কয়েকটি দল ঢাকামুখী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানা স্থানে যৌথ বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ করলেও মনোবল হারানো হানাদার বাহিনী কোন সুবিধা করতে পারে নাই।

তথ্যসূত্র:

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য,

একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান

আনন্দবাজার পত্রিকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক

সম্পর্কিত