ভোটের পরিবেশ: সবার শঙ্কা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাসী ইসি!

তাসীন মল্লিক
তাসীন মল্লিক
ভোটের পরিবেশ: সবার শঙ্কা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাসী ইসি!
নির্বাচন কমিশন। ছবি: বাসস

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই ক্রমশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ অবস্থায় খোদ নির্বাচন নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন আশা করছেন, ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা কেটে যাবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বতী সরকারের ব্যর্থতাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকেরা।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বক্তব্যে মনে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তারা আত্মবিশ্বাসী। যদিও রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। গত ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণার পরদিনই ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড ভোটের পরিবেশ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগকেই শক্তিশালী করেছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। ফাইল ছবি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। ফাইল ছবি

একই সময়ে একাধিক নির্বাচন অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে ভোট আদৌ হবে কি? বিশেষজ্ঞরা ভোটের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতে ঝুঁকি চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তারাও সন্তুষ্ট নন।

ভোটকে কেন্দ্র করে ইসি ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তিন দফা বৈঠকও করেছে। এর মধ্যে গত রোববারের বৈঠকটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দীর্ঘ অনেক বছর পর সাংবিধানিক সংস্থাটির সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিন বাহিনীর প্রধান। এর আগে এমন নজির দেখা গিয়েছিল ১/১১ সরকাররে সময়।

ওই বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘‘সার্বিকভাবে যদি আমরা বলি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আছে।’’ এ ছাড়া সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নিরাপত্তার বিষয়েও পুলিশি নিরাপত্তার উদ্যোগের কথা জানান তিনি।

গত ১৮ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ‘আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিশেষ পরিপত্রে’ নিরাপত্তা উদ্যোগের পরিকল্পনা প্রকাশ করে ইসি। সেখানে প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৩ থেকে ১৮ জন সদস্য রাখার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। বলা হয়–আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ লাখের বেশি সদস্য এবার ভোটের নিরাপত্তায় দায়িত্বে পালন করবেন।

এর মধ্যে সশস্ত্রবাহিনীর ৯০ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন থাকবে বলে জানানো হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনায় তারা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে, যা ভোটেও কার্যকর থাকবে।

শঙ্কা–অভিযোগ দলগুলোর

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি নানা অভিযোগও তুলেছে দলগুলো। বিশেষত প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ের পাশাপাশি ইসির আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।

প্রার্থীর নিরাপত্তা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার। চরচাকে তিনি বলেছেন, ‘‘নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক নেই। চিফ ইলেকশন কমিশনারের এখন দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কোথায় হ্যাম্পার হচ্ছে, কোন অফিসার কোন দিকে পক্ষপাত করছেন–এ সবগুলোকে ঠিকঠাক করা। কিন্তু তিনি তো যথাযথভাবে এটা করতে পারছেন না। পুলিশ প্রশাসন, ল এনফোর্সিং এজেন্সি অ্যাকটিভ নেই। এখন তো পুলিশ ইলেকশন কমিশনের কন্ট্রোলে, (তাদের) নির্দেশনায় চলবে।”

যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ইসির সঙ্গে সুর মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম উন্নতির আশা প্রকাশ করেছেন। আজ ইসিতে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। আমরা নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু চাই। আমরা আশা করি নির্বাচনের পরিবেশ সুস্থ থাকুক। সরকারকে আমরা আহ্বান জানিয়েছি এবং জনগণও চায় উৎসবমুখর পরিবেশে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে।’’

ভোটের পরিবেশ নিয়ে এমন উদ্বেগের মাঝেও গুরুতর সব ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। ছবি: বাসস
ভোটের পরিবেশ নিয়ে এমন উদ্বেগের মাঝেও গুরুতর সব ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। ছবি: বাসস

ভোটের পরিবেশ নিয়ে এমন উদ্বেগের মাঝেও গুরুতর সব ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। গতকাল সোমবার বেলা ১২টায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অঙ্গসংগঠন শ্রমিক শক্তির কেন্দ্রীয় সংগঠক মোতালেব শিকদারকে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। ঘটনাটি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট না হলেও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিরাপত্তা উদ্বেগকে আরও বাড়িয়েছে।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিকুস সালেহীন অভিযোগ করেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কার্যকর ভূমিকা নেই। চরচাকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা আরও জোরালো ভূমিকা চাই। এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের ইঙ্গিত দিচ্ছে না।’’

তফসিল ঘোষণার আগে তো বটেই, বিশেষ করে শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর চরচার সঙ্গে আলাপে নির্বাচনের পরিবেশ, নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন প্রমুখ। হাদি হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় দুটি সংবাদমাধ্যমের প্রধান কার্যালয়, ছায়ানট ও উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হওয়ার পর উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন দূতাবাসও।

কঠোর বার্তা ইসির

গত রোববার প্রথমবারের মতো তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক শেষে বাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, উপপ্রধান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে যুক্ত অংশীজনদের সঙ্গেও বৈঠক করে ইসি। এরপর ব্রিফিংয়ে ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, ভোটের পরিবেশ বিঘ্নিত করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। ফাইল ছবি
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। ফাইল ছবি

ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, ‘‘নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করে–এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না। বাহিনীগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, নির্বাচনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড নিরুৎসাহিত করতে এবং প্রয়োজনে বাধা দিতে যা করা প্রয়োজন, তা তারা করবেন।”

তফসিলের পর হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উদ্বৃত করে ইসির করণীয় কী হবে জানতে চাইলে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘‘জলাই-আগস্টের ঘটনার পর থেকে সব বাহিনীর প্রতি মানবিক হওয়ার এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার নির্দেশনা ছিল। তারা মনে করছেন, কেউ কেউ এই ভালো উদ্যোগের সুযোগ নিয়েছেন। ইসি কঠোরভাবে বলেছে, যারা মানবিক, তাদের প্রতি আমরা মানবিক হব, কিন্তু যারা ‘ভ্যান্ডালিজম’ করতে চায় বা নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে চায়, আমার ভাইকে হত্যা করতে চায়, তাদের প্রতি মানবিক হওয়ার দরকার নেই।”

ভোটের পরিবেশ বিঘ্ন করে–এমন ধরনের অপতৎপরতা রোধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি। আগামীকাল গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আলাদা বৈঠকের কথা রয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে যৌথবাহিনীর অভিযান আবার চালুর নির্দেশও দিয়েছে কমিশন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই ভোটের জন্য নিরাপদ নয় বলে মত নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীমের। তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঝুঁকি চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।

আব্দুল আলীম চরচাকে বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক, এটা আমি বারবার বলে আসছি। এখন জরুরি ঝুঁকি চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইসির আওতাধীন; সুতরাং তাদেরই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, এবং দ্রুত।’’

সম্পর্কিত