আরমান ভূঁইয়া

বিদায়ী বছরজুড়ে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। দলীয় অন্তর্কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও ক্ষমতার লড়াইকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে প্রাণ গেছে অন্তত ৯৮ জনের। আহত হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার।
এসব সংঘাতে জড়িয়েছে দেশের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। শুধু পুরোনো দল নয়, তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) একাধিক সহিংস ঘটনায় জড়িয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর–এই ১১ মাসে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্তর্কোন্দল ও আন্তঃদলীয় সংঘর্ষে অন্তত ৩৮৩টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৪৭৬ জন।
আসকের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার সিংহভাগই ঘটেছে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্তর্কোন্দলের কারণে। ১১ মাসে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ১৮৯টি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৩৯ জন, আহত হয়েছে ২ হাজার ৩১৭ জন। এর তুলনায় একই সময়ে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে সংঘর্ষ হয়েছে মাত্র ৫টি, যেখানে নিহত হয়েছে ৪ জন ও আহত হয়েছে ৫৬ জন।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি পটুয়াখালীর গলাচিপায় দীর্ঘদিনের অন্তর্কোন্দল মেটাতে বসা বৈঠকেই বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার লাকসামে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয় অন্তত পাঁচজন।
গত ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে একই স্থানে বিএনপির সমাবেশ আয়োজনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে।
সংঘাত হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেও। আসকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ২৬টি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয় ৩ জন এবং আহত হয় অন্তত ৪১০ জন। গত ১ ডিসেম্বর ভোলার চরফ্যাশনে জামায়াত ও বিএনপির সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হয়। এর আগে ১৯ অক্টোবর নোয়াখালী সদরে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম নিয়ে বিরোধের জেরে দুই দলের সংঘর্ষে আহত হয় অন্তত ৫০ জন। গত ১৫ মে পাবনার আটঘরিয়ায় কলেজ কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও দুই দলের মধ্যে সহিংসতা হয়।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘটিত ৩২টি সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৪৩৭ জন। এ ছাড়া বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে চারটি সংঘর্ষে আহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ ও এনসিপির মধ্যে একটি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়।

বিএনপির সঙ্গে ছাত্রলীগের দুটি সংঘর্ষে দুজন নিহত হওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে আসকের প্রতিবেদনে।
রাজনৈতিক সহিংসতার বড় অংশজুড়ে রয়েছে দলীয় ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব। আসকের তথ্য অনুযায়ী, যুবদলের মধ্যকার পক্ষগুলোর মধ্যে ১৬টি সংঘর্ষে ৮ জন নিহত ও ১৩২ জন আহত হয়েছে। আর বিএনপি ও যুবদলের সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও আহত হয়েছে ৮৪ জন। অন্যদিকে ছাত্রদলের অন্তর্কোন্দলের ৮টি ঘটনায় ১ জন নিহত ও ৭৫ জন আহত হয়েছে।
যুবদল ও ছাত্রদলের মধ্যকার ১২টি সংঘর্ষে নিহত ৪ জন এবং আহত হয়েছে শতাধিক নেতাকর্মী। এ ছাড়া বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে পুলিশের অন্তত পাঁচটি সংঘর্ষে আহত হয়েছে ৫৩ জন।
আগের বছরের তুলনা
আসকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ২৪৪টি। এসব ঘটনায় ২১ জন নিহত ও ২ হাজার ৯৬ জন আহত হয়েছিল। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রাণহানি বেড়েছে দ্বিগুন।
অন্যদিকে আরেকটি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। সংস্থাটি ১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানুয়ারি-নভেম্বর সময়কালে ৮৫২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১২৯ জন এবং ৬ হাজার ৯৬৬ জন আহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে।
এইচআরএসএসের মতে, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, সমাবেশকেন্দ্রিক সহিংসতা, কমিটি গঠন, চাঁদাবাজি ও দখলকে কেন্দ্র করেই এসব সহিংসতা ঘটেছে।
এইচআরএসএসের হিসাব অনুযায়ী নিহত ১২৯ জনের মধ্যে বিএনপির ৯১, আওয়ামী লীগের ২৩, জামায়াতের ৩, ইউপিডিএফের ৬, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১ এবং চরমপন্থী দলের ১ জন রয়েছে। এ ছাড়া তিনজনের রাজনৈতিক পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি, যার মধ্যে একজন নারীও রয়েছে।
এইচআরএসএস জানায়, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর চালানো ১৪২টি হামলায় নিহত হয়েছে ৯৫ জন। এসব হামলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। গত ১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৩০ জনের বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ, ৮ শতাধিক বাড়িঘর, রাজনৈতিক কার্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক সহিংসতাকে আরও উসকে দিয়েছে। দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঘাটতি ও অপরাধী চক্রের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, দেশের রাজনীতি ক্রমেই সহিংসতার পথে হাঁটছে। দলীয় কোন্দল ও ক্ষমতার লড়াইয়ে সাধারণ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও হচ্ছে ভুক্তভোগী। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জবাবদিহি ছাড়া এই সহিংসতার চক্র ভাঙা কঠিন হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “রাজনৈতিক সহিংসতা হঠাৎ করে বেড়েছে–এমনটা আমি মনে করি না। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন মাত্র দুই মাস আগে হঠাৎ করে ব্যাপক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সীমিত পরিসরে কিছু সহিংসতা দেখা যেতেই পারে। এটিকে অতিরঞ্জিত করে দেখার কারণ নেই।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করি। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বড় ধরনের সহিংসতা ঠেকাতে সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। জনগণের সচেতনতা, প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা থাকলে নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা কমে আসবে এবং ঐক্যমতের ভিত্তিতে কাজ করলে এ ধরনের সহিংসতা স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।”
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, “গত ১৬ বছর ধরে গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতি, সন্ত্রাস এবং গুম-খুনের মতো ঘটনার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে গভীর হতাশা ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং আগের সরকারের সময়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও লুট হওয়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় সন্ত্রাস নির্মূল ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন থাকা জরুরি ছিল।”
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ প্রসঙ্গে জামায়াতের এই নেতা বলেন, তার জানামতে জামায়াত কোনো সংঘর্ষে জড়িত নয়। বরং বিভিন্ন স্থানে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, একটি মহল দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না এবং পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায় সরকারের দায়িত্ব এসব গোষ্ঠীকে শক্ত হাতে দমন করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব ঐক্যের মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন চরচাকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এখন এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, কিছু রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী হামলাকেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। রাজনৈতিক দাবি আদায়ের নামে এ ধরনের সহিংসতা সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলছে।”
নূর খান লিটন বলেন, “সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং দলগুলোর অভ্যন্তরেও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ও স্পষ্ট বার্তা দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং সরকারের দ্ব্যর্থহীন অবস্থান জরুরি। একই সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা মোকাবিলায় জনগণের ঐক্য ও সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।”

বিদায়ী বছরজুড়ে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। দলীয় অন্তর্কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও ক্ষমতার লড়াইকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে প্রাণ গেছে অন্তত ৯৮ জনের। আহত হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার।
এসব সংঘাতে জড়িয়েছে দেশের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। শুধু পুরোনো দল নয়, তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) একাধিক সহিংস ঘটনায় জড়িয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর–এই ১১ মাসে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্তর্কোন্দল ও আন্তঃদলীয় সংঘর্ষে অন্তত ৩৮৩টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৪৭৬ জন।
আসকের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার সিংহভাগই ঘটেছে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্তর্কোন্দলের কারণে। ১১ মাসে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ১৮৯টি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৩৯ জন, আহত হয়েছে ২ হাজার ৩১৭ জন। এর তুলনায় একই সময়ে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে সংঘর্ষ হয়েছে মাত্র ৫টি, যেখানে নিহত হয়েছে ৪ জন ও আহত হয়েছে ৫৬ জন।
চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি পটুয়াখালীর গলাচিপায় দীর্ঘদিনের অন্তর্কোন্দল মেটাতে বসা বৈঠকেই বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার লাকসামে শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয় অন্তত পাঁচজন।
গত ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে একই স্থানে বিএনপির সমাবেশ আয়োজনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে।
সংঘাত হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেও। আসকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ২৬টি সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয় ৩ জন এবং আহত হয় অন্তত ৪১০ জন। গত ১ ডিসেম্বর ভোলার চরফ্যাশনে জামায়াত ও বিএনপির সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হয়। এর আগে ১৯ অক্টোবর নোয়াখালী সদরে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম নিয়ে বিরোধের জেরে দুই দলের সংঘর্ষে আহত হয় অন্তত ৫০ জন। গত ১৫ মে পাবনার আটঘরিয়ায় কলেজ কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও দুই দলের মধ্যে সহিংসতা হয়।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘটিত ৩২টি সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৪৩৭ জন। এ ছাড়া বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে চারটি সংঘর্ষে আহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ ও এনসিপির মধ্যে একটি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়।

বিএনপির সঙ্গে ছাত্রলীগের দুটি সংঘর্ষে দুজন নিহত হওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে আসকের প্রতিবেদনে।
রাজনৈতিক সহিংসতার বড় অংশজুড়ে রয়েছে দলীয় ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব। আসকের তথ্য অনুযায়ী, যুবদলের মধ্যকার পক্ষগুলোর মধ্যে ১৬টি সংঘর্ষে ৮ জন নিহত ও ১৩২ জন আহত হয়েছে। আর বিএনপি ও যুবদলের সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও আহত হয়েছে ৮৪ জন। অন্যদিকে ছাত্রদলের অন্তর্কোন্দলের ৮টি ঘটনায় ১ জন নিহত ও ৭৫ জন আহত হয়েছে।
যুবদল ও ছাত্রদলের মধ্যকার ১২টি সংঘর্ষে নিহত ৪ জন এবং আহত হয়েছে শতাধিক নেতাকর্মী। এ ছাড়া বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে পুলিশের অন্তত পাঁচটি সংঘর্ষে আহত হয়েছে ৫৩ জন।
আগের বছরের তুলনা
আসকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ২৪৪টি। এসব ঘটনায় ২১ জন নিহত ও ২ হাজার ৯৬ জন আহত হয়েছিল। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রাণহানি বেড়েছে দ্বিগুন।
অন্যদিকে আরেকটি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। সংস্থাটি ১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানুয়ারি-নভেম্বর সময়কালে ৮৫২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১২৯ জন এবং ৬ হাজার ৯৬৬ জন আহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে।
এইচআরএসএসের মতে, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, সমাবেশকেন্দ্রিক সহিংসতা, কমিটি গঠন, চাঁদাবাজি ও দখলকে কেন্দ্র করেই এসব সহিংসতা ঘটেছে।
এইচআরএসএসের হিসাব অনুযায়ী নিহত ১২৯ জনের মধ্যে বিএনপির ৯১, আওয়ামী লীগের ২৩, জামায়াতের ৩, ইউপিডিএফের ৬, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১ এবং চরমপন্থী দলের ১ জন রয়েছে। এ ছাড়া তিনজনের রাজনৈতিক পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি, যার মধ্যে একজন নারীও রয়েছে।
এইচআরএসএস জানায়, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর চালানো ১৪২টি হামলায় নিহত হয়েছে ৯৫ জন। এসব হামলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। গত ১১ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৩০ জনের বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ, ৮ শতাধিক বাড়িঘর, রাজনৈতিক কার্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক সহিংসতাকে আরও উসকে দিয়েছে। দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঘাটতি ও অপরাধী চক্রের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, দেশের রাজনীতি ক্রমেই সহিংসতার পথে হাঁটছে। দলীয় কোন্দল ও ক্ষমতার লড়াইয়ে সাধারণ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও হচ্ছে ভুক্তভোগী। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জবাবদিহি ছাড়া এই সহিংসতার চক্র ভাঙা কঠিন হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “রাজনৈতিক সহিংসতা হঠাৎ করে বেড়েছে–এমনটা আমি মনে করি না। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন মাত্র দুই মাস আগে হঠাৎ করে ব্যাপক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সীমিত পরিসরে কিছু সহিংসতা দেখা যেতেই পারে। এটিকে অতিরঞ্জিত করে দেখার কারণ নেই।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করি। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে বড় ধরনের সহিংসতা ঠেকাতে সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। জনগণের সচেতনতা, প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা থাকলে নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা কমে আসবে এবং ঐক্যমতের ভিত্তিতে কাজ করলে এ ধরনের সহিংসতা স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।”
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, “গত ১৬ বছর ধরে গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতি, সন্ত্রাস এবং গুম-খুনের মতো ঘটনার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে গভীর হতাশা ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং আগের সরকারের সময়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও লুট হওয়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় সন্ত্রাস নির্মূল ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন থাকা জরুরি ছিল।”
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ প্রসঙ্গে জামায়াতের এই নেতা বলেন, তার জানামতে জামায়াত কোনো সংঘর্ষে জড়িত নয়। বরং বিভিন্ন স্থানে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, একটি মহল দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না এবং পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায় সরকারের দায়িত্ব এসব গোষ্ঠীকে শক্ত হাতে দমন করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব ঐক্যের মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন চরচাকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এখন এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, কিছু রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী হামলাকেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। রাজনৈতিক দাবি আদায়ের নামে এ ধরনের সহিংসতা সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলছে।”
নূর খান লিটন বলেন, “সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং দলগুলোর অভ্যন্তরেও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ও স্পষ্ট বার্তা দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং সরকারের দ্ব্যর্থহীন অবস্থান জরুরি। একই সঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা মোকাবিলায় জনগণের ঐক্য ও সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।”