ফজলে রাব্বি

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিক আলমের বাসায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এ জন্য তাকে নিয়ম মেনে বিলও পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ঘরের রান্নার কাজে তাকে বাজার থেকে এলপিজি কিনে ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য তাকে প্রতি মাসে হাজার টাকার বেশি বাড়তি গুনতে হয়।
রফিক আলম একা নন। এভাবে রাজধানী ও এর আশাপাশের এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলো এক ধরনের প্রতারণা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। গত ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর শনির আখড়ায় এমন ভুক্তভোগী মানুষেরা বাধ্য হয়ে বিক্ষোভে নেমেছিল। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
গ্যাস নিয়ে বৈষম্যটা হয় আসলে বহুমাত্রিক। রফিক আলমদের মতো করে একটা অংশের কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে, যাদের বাসায় গ্যাসের পাইপলাইন টানা আছে, যা দিয়ে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাকিদের কথা বিবেচনায় নিলে এই অংশকেও এমনকি সৌভাগ্যবান বলতে হবে। কারণ, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ সরকারি দামে গ্যাস পায় না। তাদের জন্য এমনকি পাইপলাইনই নেই।
একই দেশে বাস করে গৃহস্থালী কাজে গ্যাসের পেছনে কারও মাসে খরচ করতে হচ্ছে ৫০০ টাকা, আর কাউকে গুণতে হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ পাইপলাইনে গ্যাসের সুবিধা নিয়ে সরকারের বিপুল ভর্তুকি ভোগ করছেন। বাকি ৮৯ শতাংশ মানুষের ওপর চেপে বসছে আকাশচুম্বী এলপিজি বা লাকড়ির খরচের বোঝা।
জ্বালানি খাতে চলা এই দৃশ্যমান বৈষম্য কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের সুষম সুযোগ বণ্টনের এক বড় অন্তরায় বলে মনে করেন জ্বালানি বিশ্লেষকরা।
প্রিপেইড বনাম নন-মিটারড (ফিক্সড রেট)
বাংলাদেশে গৃহস্থালী পর্যায়ে সবচেয়ে বড় বৈষম্যটি কাজ করছে গ্যাসের বিলিং পদ্ধতিতে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাঠপর্যায়ের ভোক্তা জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, প্রিপেইড মিটারের আওতাধীন একটি ছোট বা মাঝারি পরিবারের রান্নাবাবদ মাসিক খরচ হয় গড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। অন্যদিকে, একই পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করেও নন-মিটারড গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে ১,০৮০ টাকা। অর্থাৎ, মিটারবিহীন গ্রাহকেরা মাসে অন্তত ৪০০-৫০০ টাকা বেশি দিচ্ছেন গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলোকে।
বিইআরসির সবশেষ আদেশ অনুযায়ী, বর্তমানে এক চুলার মাসিক বিল ৯৯০ টাকা এবং দুই চুলার বিল ১,০৮০ টাকা। গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার করুন বা না করুন, তাকে এই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতেই হয়। অন্যদিকে প্রিপেইড গ্রাহকরা প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাসের জন্য মাত্র ১৮ টাকা পরিশোধ করেন।
পাইপলাইনের গ্যাসের দাম নির্ধারণেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তার সবশেষ আদেশে, দুই চুলার গ্রাহক মাসে ৬৬ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে ধরে নিয়ে ১০৮০ টাকা বিল নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি পরিবার গড়ে ৩০ থেকে ৪০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে। অর্থাৎ, মিটারবিহীন গ্রাহকের কাছ থেকে মাসে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ ঘনমিটার গ্যাসের দাম অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে।
শূন্য চুলার পূর্ণ বিল
শীত এলেই রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকাসহ দেশের লাখ লাখ গ্রাহক পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ সংকটে ভোগেন। এই সংকটের তীব্রতা এবার রাজধানীর শনির আখড়াসহ আশপাশের এলাকার মানুষকে পথে নামতে বাধ্য করেছে, যার উদাহরণ শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। এই সংকটে ভোগা পরিবারগুলোর রান্নার খরচে নিয়মিত গ্যাস বিলের সাথে যোগ হচ্ছে অন্তত একটি এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। বিইআরসির ডিসেম্বর মাসের আদেশ অনুযায়ী ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১,২৫৩ টাকা।

অর্থাৎ, এই নন–মিটারড পাইপলাইনে গ্যাস পরিষেবা গ্রহণকারী পরিবারগুলোকে প্রতি মাসে নির্ধারিত বিল পরিশোধের পাশাপাশি আরও অন্তত ১২৫৩ টাকা করে গুনতে হচ্ছে। বলে রাখা ভালো, বিইআরসির নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার পাওয়া সোনার হরিন পাওয়ার মতোই বিষয়।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম চরচাকে বলেন, “গ্যাসের এই মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বৈষম্যমূলক এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিতরণ কোম্পানিগুলোর অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
বঞ্চনার অন্যদিক
এ তো গেল পাইপলাইনে গ্যাস বণ্টনের বৈষম্যের একটি দিক। অন্যদিকে রয়েছে বঞ্চনার নিষ্ঠুর এক পরিসংখ্যান। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪৩-৪৫ লাখ। এর প্রায় ৮৮ শতাংশই আবাসিক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবার রয়েছে। অর্থাৎ, দেশের মাত্র ১০-১১ শতাংশ পরিবারকে রাষ্ট্র পাইপলাইনে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। এই ১১ শতাংশ গ্রাহকের জন্য বিপুল পরিমাণ ভর্তুকিও দিচ্ছে সরকার। বাকি ৯০ শতাংশ মানুষকে চড়া মূল্যে বাজার থেকে এলপিজি বা লাকড়ি কিনতে হচ্ছে।
এলপিজি অপারেটরদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) তথ্যমতে, দেশের মোট পরিবারের ২৫-৩০ শতাংশ এখন এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ডিসেম্বর মাসের আদেশ অনুযায়ী, মাঝারি একটি পরিবারের মাসে ১২ কেজির দেড়টি করে সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয় বলে নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। সেক্ষেত্রে ১২ কেজির সিলিন্ডারের নির্ধারিত দাম বিবেচনায় ওই পরিবারের রান্না বাবদ মাসে খরচ হয় ১,৮৮০ টাকা।

বিবিএসের সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০-৬০ শতাংশের বেশি গ্রামীণ পরিবার এখনো লাকড়ি বা শুকনো লতা-পাতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) জ্বালানি ও দারিদ্র্য বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার ও গবেষণাপত্রে গ্রামীণ মানুষের জ্বালানি ব্যবহারের ধরন ও খরচের যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে দেখা যায়, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, এক মণ লাকড়ির দাম এলাকাভেদে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। ফলে একটি সাধারণ পরিবারের মাসে জ্বালানি বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,৫০০ টাকা, যা পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহারকারীদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
এই তথ্য অনুযায়ী, সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে অগ্রাহ্য করে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য জ্বালানি ব্যবহারে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
আইন কি ভোক্তার পাশে আছে?
গ্রাহক পর্যায়ে এই জ্বালানি বৈষম্য কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করে না বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো। গ্যাসের এই বৈষম্য সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদের (২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদ) সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন, ২০০৩-এর ধারা ২২ অনুযায়ী কমিশন জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং ‘ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা’ করতে বাধ্য। ধারা ৩৪ (ট্যারিফ নির্ধারণ) অনুযায়ী, ট্যারিফ বা দাম নির্ধারণের সময় কমিশনকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখতে হবে। যদি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির গ্রাহক (ফিক্সড রেট গ্রাহক) বৈষম্যের শিকার হন, তবে কমিশনের কাছে আপত্তি জানানোর সুযোগ আছে এই আইনে।
এখানেই শেষ নয়, গ্যাস বিপণন বিধিমালার শর্তানুযায়ী, “বিতরণ কোম্পানি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে বাধ্য। যদি সরবরাহ না থাকে, তবে গ্রাহক সেই সময়ের বিল মওকুফের দাবি করার আইনি অধিকার রাখেন।”
অর্থাৎ, গ্রাহকের আইনি অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিব্বি পার পেয়ে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। আইন অনুযায়ী, আদালতের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের (গ্যাস না দিয়ে বিল নেওয়া) জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুযোগ থাকলেও কোনো গ্রাহক এখনো আইনি প্রতিকার চেয়েছেন বলে জানা যায় না।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিক আলমের বাসায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এ জন্য তাকে নিয়ম মেনে বিলও পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ঘরের রান্নার কাজে তাকে বাজার থেকে এলপিজি কিনে ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য তাকে প্রতি মাসে হাজার টাকার বেশি বাড়তি গুনতে হয়।
রফিক আলম একা নন। এভাবে রাজধানী ও এর আশাপাশের এলাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলো এক ধরনের প্রতারণা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। গত ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর শনির আখড়ায় এমন ভুক্তভোগী মানুষেরা বাধ্য হয়ে বিক্ষোভে নেমেছিল। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
গ্যাস নিয়ে বৈষম্যটা হয় আসলে বহুমাত্রিক। রফিক আলমদের মতো করে একটা অংশের কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে, যাদের বাসায় গ্যাসের পাইপলাইন টানা আছে, যা দিয়ে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাকিদের কথা বিবেচনায় নিলে এই অংশকেও এমনকি সৌভাগ্যবান বলতে হবে। কারণ, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ সরকারি দামে গ্যাস পায় না। তাদের জন্য এমনকি পাইপলাইনই নেই।
একই দেশে বাস করে গৃহস্থালী কাজে গ্যাসের পেছনে কারও মাসে খরচ করতে হচ্ছে ৫০০ টাকা, আর কাউকে গুণতে হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ পাইপলাইনে গ্যাসের সুবিধা নিয়ে সরকারের বিপুল ভর্তুকি ভোগ করছেন। বাকি ৮৯ শতাংশ মানুষের ওপর চেপে বসছে আকাশচুম্বী এলপিজি বা লাকড়ির খরচের বোঝা।
জ্বালানি খাতে চলা এই দৃশ্যমান বৈষম্য কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং সাধারণ মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের সুষম সুযোগ বণ্টনের এক বড় অন্তরায় বলে মনে করেন জ্বালানি বিশ্লেষকরা।
প্রিপেইড বনাম নন-মিটারড (ফিক্সড রেট)
বাংলাদেশে গৃহস্থালী পর্যায়ে সবচেয়ে বড় বৈষম্যটি কাজ করছে গ্যাসের বিলিং পদ্ধতিতে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাঠপর্যায়ের ভোক্তা জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, প্রিপেইড মিটারের আওতাধীন একটি ছোট বা মাঝারি পরিবারের রান্নাবাবদ মাসিক খরচ হয় গড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। অন্যদিকে, একই পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করেও নন-মিটারড গ্রাহককে গুনতে হচ্ছে ১,০৮০ টাকা। অর্থাৎ, মিটারবিহীন গ্রাহকেরা মাসে অন্তত ৪০০-৫০০ টাকা বেশি দিচ্ছেন গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলোকে।
বিইআরসির সবশেষ আদেশ অনুযায়ী, বর্তমানে এক চুলার মাসিক বিল ৯৯০ টাকা এবং দুই চুলার বিল ১,০৮০ টাকা। গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার করুন বা না করুন, তাকে এই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতেই হয়। অন্যদিকে প্রিপেইড গ্রাহকরা প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাসের জন্য মাত্র ১৮ টাকা পরিশোধ করেন।
পাইপলাইনের গ্যাসের দাম নির্ধারণেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তার সবশেষ আদেশে, দুই চুলার গ্রাহক মাসে ৬৬ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে ধরে নিয়ে ১০৮০ টাকা বিল নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি পরিবার গড়ে ৩০ থেকে ৪০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে। অর্থাৎ, মিটারবিহীন গ্রাহকের কাছ থেকে মাসে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ ঘনমিটার গ্যাসের দাম অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে।
শূন্য চুলার পূর্ণ বিল
শীত এলেই রাজধানী ঢাকার অনেক এলাকাসহ দেশের লাখ লাখ গ্রাহক পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ সংকটে ভোগেন। এই সংকটের তীব্রতা এবার রাজধানীর শনির আখড়াসহ আশপাশের এলাকার মানুষকে পথে নামতে বাধ্য করেছে, যার উদাহরণ শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। এই সংকটে ভোগা পরিবারগুলোর রান্নার খরচে নিয়মিত গ্যাস বিলের সাথে যোগ হচ্ছে অন্তত একটি এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। বিইআরসির ডিসেম্বর মাসের আদেশ অনুযায়ী ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১,২৫৩ টাকা।

অর্থাৎ, এই নন–মিটারড পাইপলাইনে গ্যাস পরিষেবা গ্রহণকারী পরিবারগুলোকে প্রতি মাসে নির্ধারিত বিল পরিশোধের পাশাপাশি আরও অন্তত ১২৫৩ টাকা করে গুনতে হচ্ছে। বলে রাখা ভালো, বিইআরসির নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার পাওয়া সোনার হরিন পাওয়ার মতোই বিষয়।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম চরচাকে বলেন, “গ্যাসের এই মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বৈষম্যমূলক এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। বিতরণ কোম্পানিগুলোর অদক্ষতা ও দুর্নীতির দায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
বঞ্চনার অন্যদিক
এ তো গেল পাইপলাইনে গ্যাস বণ্টনের বৈষম্যের একটি দিক। অন্যদিকে রয়েছে বঞ্চনার নিষ্ঠুর এক পরিসংখ্যান। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪৩-৪৫ লাখ। এর প্রায় ৮৮ শতাংশই আবাসিক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবার রয়েছে। অর্থাৎ, দেশের মাত্র ১০-১১ শতাংশ পরিবারকে রাষ্ট্র পাইপলাইনে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। এই ১১ শতাংশ গ্রাহকের জন্য বিপুল পরিমাণ ভর্তুকিও দিচ্ছে সরকার। বাকি ৯০ শতাংশ মানুষকে চড়া মূল্যে বাজার থেকে এলপিজি বা লাকড়ি কিনতে হচ্ছে।
এলপিজি অপারেটরদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) তথ্যমতে, দেশের মোট পরিবারের ২৫-৩০ শতাংশ এখন এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ডিসেম্বর মাসের আদেশ অনুযায়ী, মাঝারি একটি পরিবারের মাসে ১২ কেজির দেড়টি করে সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয় বলে নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। সেক্ষেত্রে ১২ কেজির সিলিন্ডারের নির্ধারিত দাম বিবেচনায় ওই পরিবারের রান্না বাবদ মাসে খরচ হয় ১,৮৮০ টাকা।

বিবিএসের সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০-৬০ শতাংশের বেশি গ্রামীণ পরিবার এখনো লাকড়ি বা শুকনো লতা-পাতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) জ্বালানি ও দারিদ্র্য বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার ও গবেষণাপত্রে গ্রামীণ মানুষের জ্বালানি ব্যবহারের ধরন ও খরচের যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে দেখা যায়, বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, এক মণ লাকড়ির দাম এলাকাভেদে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। ফলে একটি সাধারণ পরিবারের মাসে জ্বালানি বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,৫০০ টাকা, যা পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহারকারীদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
এই তথ্য অনুযায়ী, সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে অগ্রাহ্য করে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য জ্বালানি ব্যবহারে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
আইন কি ভোক্তার পাশে আছে?
গ্রাহক পর্যায়ে এই জ্বালানি বৈষম্য কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করে না বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো। গ্যাসের এই বৈষম্য সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদের (২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদ) সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন, ২০০৩-এর ধারা ২২ অনুযায়ী কমিশন জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবং ‘ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা’ করতে বাধ্য। ধারা ৩৪ (ট্যারিফ নির্ধারণ) অনুযায়ী, ট্যারিফ বা দাম নির্ধারণের সময় কমিশনকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখতে হবে। যদি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির গ্রাহক (ফিক্সড রেট গ্রাহক) বৈষম্যের শিকার হন, তবে কমিশনের কাছে আপত্তি জানানোর সুযোগ আছে এই আইনে।
এখানেই শেষ নয়, গ্যাস বিপণন বিধিমালার শর্তানুযায়ী, “বিতরণ কোম্পানি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে বাধ্য। যদি সরবরাহ না থাকে, তবে গ্রাহক সেই সময়ের বিল মওকুফের দাবি করার আইনি অধিকার রাখেন।”
অর্থাৎ, গ্রাহকের আইনি অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিব্বি পার পেয়ে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। আইন অনুযায়ী, আদালতের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের (গ্যাস না দিয়ে বিল নেওয়া) জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুযোগ থাকলেও কোনো গ্রাহক এখনো আইনি প্রতিকার চেয়েছেন বলে জানা যায় না।