তারেকের ফেরায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কোন দিকে?

তারেকের ফেরায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কোন দিকে?
তারেক রহমান। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাংলাদেশে ফেরা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়’ বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।

দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার লন্ডন ছেড়ে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন তারেক রহমান। তার এই ফেরা কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো তারেকের প্রত্যাবর্তনকে ‘কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা’ এবং ‘নিরাপত্তা উদ্বেগের’ চশমা দিয়ে দেখছে।

ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ তারেক রহমানের এই রাজসিক প্রত্যাবর্তনকে ভারতের জন্য ‘অস্বস্তিকর বাস্তবতা’ হিসাবে দেখছে। তাদের নিবন্ধে বলা হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে দিল্লির কর্মকর্তারা বিএনপিকে একটি ফুরিয়ে যাওয়া শক্তি হিসেবে অবজ্ঞা করে আসছিলেন, কিন্তু তারেক রহমানের বিশাল সংবর্ধনা জনসভা সেই ভুল ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

গত ১৫ বছর ভারত শেখ হাসিনা সরকারের ওপর যেভাবে বিনিয়োগ করেছিল, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের ফলে ভারতের নীতি-নির্ধারকরা তাদের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিটি নতুন করে সাজাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

পত্রিকাটি মনে করে, বিএনপির সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা নয়াদিল্লির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারেক রহমানের অতীত ইতিহাস নিয়ে ভারতের যে নিরাপত্তা উদ্বেগ, বিশেষ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা এবং উগ্রপন্থার উত্থান নিয়ে ছিল, তা প্রশমিত করতে তারেক কী করেন সে বিষয়টির দিকে অবশ্যই চোখ থাকবে ভারতের। ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের ভূত এখনো ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করিডোরে ঘুরে বেড়ায়। তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার আবার ভারত-বিরোধী বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেবে কি না কিংবা পাকিস্তানের আইএসআই-এর দিকে বেশি ঝুঁকে পড়বে কি না তা নিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখনো শঙ্কিত থাকাকে স্বাভাবিক বলে মনে করে দ্য ইকোনোমিস্ট।

তবে, তারেকের অতীত নিয়ে যতই উদ্বেগ থাকুক, চীনের কথা বিবেচনায় নিয়ে ভারত বাধ্য হয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলবে বলে মনে করে প্রভাবশালী এই ব্রিটিশ পত্রিকা। ভারত যদি বিএনপির প্রতি শীতল মনোভাব বজায় রাখে তাহলে তারেকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের বলয়ে ঢুকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে। অর্থাৎ পছন্দ না হলেও বর্তমান বাস্তবতার তারেক রহমানের প্রতি দিল্লির পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে। নিবন্ধের শেষে দ্য ইকোনমিস্ট স্পষ্ট করে বলছে, তারেককে ঘিরে ভারতের এখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা।

তবে, রয়টার্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ক্ষমতার রদবদল এবং তারেক রহমানের প্রভাবের ফলে ভারতের ‘কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট’ বা ট্রানজিট সুবিধার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয় নিরাপত্তার স্বার্থেই ভারত এখন ‘এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখা’র নীতি থেকে সরে এসে বাস্তববাদী কূটনীতি গ্রহণ করছে বা করবে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার ধারণা, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারত-বিরোধী যে মনোভাব দানা বেঁধেছে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন তাকে একটি রাজনৈতিক রূপ দিতে পারে। আল জাজিরা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ভারত এখন বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বোঝাপড়া করতে আগ্রহী হবে। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে তারেক রহমানের জন্যও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা তার জন্য জরুরি বলে মনে করছে আল জাজিরা।

আঞ্চলিক কূটনীতি নিয়ে কাজ বিশেষায়িত প্লাটফর্ম সাউথ এশিয়া মনিটর তারেক রহমানের ফিরে আসাকে ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জিং বলে মন্তব্য করেছে। ‘দ্য তারেক রহমান ফ্যাক্টর ইন ইন্ডিয়া বাংলাদেশ টাইস’ শিরোনামে করা প্রতিবেদনে তারা বলছে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ভারতের প্রতিবেশী নীতির জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। তবে, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক কার্যকর থাকবে নাকি ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকের সেই সন্দেহপ্রবণ যুগে ফিরে যাবে তা তারেকের নেতৃত্বের ওপরও নির্ভর করবে বলেও বলা হয় প্রতিবেদনে।

অতি সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক নিবন্ধগুলোর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তারেক রহমান তার বার্তায় ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বললেও গত ১৫ বছরের ভারতের একতরফা নীতির সমালোচনা করেছেন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের মনোভাবকে প্রাধান্য দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

নয়াদিল্লির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) বা মার্কিন থিঙ্কট্যাংক উড্রো উইলসন সেন্টার-এর মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধগুলো বলছে যে, ভারত এখন ‘Wait and Watch’ বা অপেক্ষা করো এবং পর্যবেক্ষণ করো নীতিতে আছে। তারা তারেক রহমানের জনসভাগুলোতে ভারতের প্রতি অথবা ভারতকে নিয়ে কী বার্তা দেন সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। আন্তর্জাতিক মহলের মতে, তারেকের প্রত্যাবর্তনে ভারত একটি বড় কূটনৈতিক পরীক্ষায় পড়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক টানাপোড়েনের হলেও, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান উগ্রপন্থী ও ইসলামপন্থীদের উত্থান ভারতকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। সেই কথার প্রতিফলন পাওয়া যায় আজ শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীন জয়সওয়ালের কথাতেও।

এই ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন, “বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধসহ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চরমপন্থিদের বিরামহীন শত্রুতা গভীর উদ্বেগের।”

তারেক রহমানের বাংলাদেশে ফেরা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নে রণধীর বলেন, “বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনকে সমর্থন করে ভারত। এই ঘটনাকে সেই প্রেক্ষাপট থেকেই দেখা উচিত।”

বর্তমান বাস্তবতায় দিল্লির নীতিনির্ধারকরা বিএনপিকে একটি ‘তুলনামূলক উদার বিকল্প’ হিসেবে দেখতে বাধ্য হচ্ছে বলেও মনে করছেন কূটনীতিকরা।

সম্পর্কিত