চরচা ডেস্ক

ইহুদিদের বসতি অর মেয়ার আয়তনে খুবই ছোট। মুষ্টিমেয় কয়েকটি অস্থায়ী আশ্রয় নিয়ে গড়ে ওঠা এই ঘাঁটিটি ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরের একটি পাহাড়ের চূড়ায়, কাঁচা রাস্তার একেবারে শেষে অবস্থিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ এসব আশ্রয়ই একটি পূর্ণাঙ্গ ইসরায়েলি আবাসন প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও স্বীকার করেছেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের উত্থান ঠেকানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এই প্রক্রিয়াটি সবসময় অহিংস থাকেনি। এক বেদুঈন পরিবার রয়টার্সকে জানিয়েছে, গত বছর অর মেয়ার থেকে নেমে আসা হামলাকারীরা ককটেল নিক্ষেপ করে ফিলিস্তিনিদের তাদের মালিকানাধীন জমি থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরিবারটি আশঙ্কা করছে, তারা আর কখনো হয়তো সেখানে ফিরতে পারবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে অর মেয়ারের চ্যানেলে প্রকাশিত বার্তাগুলোতে দেখা যায়, বেদুঈন পশুপালকদের উচ্ছেদের মাধ্যমে কৌশলগত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার বিষয়টি তারা উদযাপন করছে। এসব বার্তায় নতুন বসতি স্থাপনকারীদের দৃঢ় সংকল্পও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় ৭৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা যে ভূখণ্ডকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে ইসরায়েলের বসতি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে।
ইসরায়েলি এনজিও পিস নাউ জানিয়েছে, ২০২৫ সালে পশ্চিম তীরে ৮০টি বসতি ঘাঁটি নির্মাণ করা হয়েছে, যা ১৯৯১ সালের পর সর্বোচ্চ। গত ২১ ডিসেম্বর ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা সাবেক বসতিসহ আরও ১৯টি বসতি অনুমোদন দেয়। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ বলেন, যেকোনো উপায়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঠেকানোই তাদের লক্ষ্য।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দল ইসরায়েলি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই পশ্চিম তীরের জমিতে বসতি গড়ে তুলেছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো এসব শিবির গুঁড়িয়ে দিলেও সেগুলো প্রায়ই আবার গড়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বসতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্মোত্রিচ আরও বহু ঘাঁটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
পশ্চিম তীরকে যেভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে
ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই পশ্চিম তীরের প্রধান সড়কগুলোর আশপাশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সব ধরনের বসতিকে সামরিক দখলসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অবৈধ মনে করলেও ইসরায়েল এই অবস্থানের সঙ্গে একমত নয়।
গত সেপ্টেম্বর অর মেয়ারের বসতি স্থাপনকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা হয়, সেখানে বলা হয় ‘এই ভূমিতে আমাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার পর থেকে আমরা নয়টি অবৈধ বেদুঈন ঘাঁটি সরিয়ে দিয়েছি এবং প্রায় ৬ হাজার দুনাম জমি আবার ইহুদি মালিকানায় ফিরিয়ে এনেছি।’ এখানে দুনাম একটি ভূমি পরিমাপের একক, যা প্রায় এক হাজার বর্গমিটারের সমান।
রয়টার্স বেদুঈনদের ওপর চালানো সব হামলা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। প্রায় দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই ঘাঁটির বাসিন্দারা সংবাদ সংস্থাটির সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা নিয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বিষয়টিকে একটি প্রান্তিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কাজ বলে উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন, ফিলিস্তিনিদের হামলায় ইসরায়েলিদের ক্ষয়ক্ষতির খবর গণমাধ্যমে যথাযথভাবে উঠে আসে না।
অর মেয়ারের টেলিগ্রাম চ্যানেলটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে প্রকাশিত বার্তাগুলোতে জমি দখলের সুস্পষ্ট পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রয়টার্সের অনুসন্ধানে একই ধরনের আরও এক ডজন টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জেরুজালেমভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক মিলেনা আনসারি বলেন, “এটি সহিংসতার একটি পদ্ধতিগত ধারা, তাদের কার্যক্রমেই তা স্পষ্ট।”
বেদুঈন পরিবারগুলোর বাস্তবতা
মুসাবাহ পরিবার এই অঞ্চলের একটি বেদুঈন পরিবার। তারা জানায়, জুন মাসে রাতে অর মেয়ারের দিক থেকে আসা লোকজন তাদের ওপর হামলা চালায়। ডিসেম্বরে রয়টার্সের একটি দল সেখানে গেলে তাদের বাড়ি ও গোয়ালঘরের পোড়া ধ্বংসাবশেষ তখনও পড়ে থাকতে দেখা যায়।
৩৯ বছর বয়সী বেদুঈন রাখাল শাহাদা মুসাবাহ বলেন, “আল্লাহর রহমতে আমরা এখানে শান্তিতে বসবাস করছিলাম। সেই রাতে ওরা আগুন লাগাতে শুরু করে এবং সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। আমাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।” তিনি বর্তমানে নিকটবর্তী ফিলিস্তিনি গ্রাম দেইর দিবওয়ানে আশ্রয় নিয়েছেন।
এই ঘটনার বিষয়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, ওই রাতে কয়েক ডজন ইসরায়েলি বেসামরিক ব্যক্তি দেইর দিবওয়ানের সম্পত্তিতে আগুন দেয়, তবে নিরাপত্তা বাহিনী পৌঁছানোর আগেই তারা সরে পড়ে। দেইর দিবওয়ান পরিষদের এক কর্মকর্তা জানান, প্রায় ৬০ জন ইসরায়েলি এই হামলায় জড়িত ছিল। তাদের নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে কয়েকজন গ্রামবাসী আহত হন।
একটি টেলিফোন কলে অর মেয়ারের বসতি স্থাপনকারী এলকানাহ নাখমানি রয়টার্সের প্রতিবেদকদের ঘাঁটির দিকে না এগোতে হুমকি দেন এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। নভেম্বর ২০২৪ সালে অর মেয়ারের বসতি স্থাপনকারীরা অভিযোগ করেন, ফিলিস্তিনিরা তাদের ভেড়া বিষ দিয়ে হত্যা করেছে যদিও মুসাবাহ পরিবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরায়েলি পর্যবেক্ষক সংস্থা ইয়েশ দিন জানায়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে তারা বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার শত শত ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, তবে মাত্র ২ শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। রয়টার্স এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। ইসরায়েলের পুলিশ ও সামরিক বাহিনী এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে পশ্চিম তীরে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অধিকাংশই ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে এবং কিছু বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতায়। একই সময়ে ফিলিস্তিনিদের হামলায় ৫৭ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন।
অস্থায়ী শিবির থেকে স্থায়ী বসতি
অর মেয়ার গোষ্ঠী তাদের লক্ষ্য নিয়ে প্রকাশ্যেই কথা বলে আসছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে তাদের টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে জানানো হয়, তারা অফরা অঞ্চলের কাছে একটি কৌশলগত পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়তে চায়, যার উদ্দেশ্য পশ্চিম তীরকে খণ্ডিত করে সেখানে ইহুদি উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী রয়টার্সকে জানায়, অর মেয়ারে বসতি স্থাপন অবৈধ এবং নিরাপত্তা বাহিনী একাধিকবার এটি উচ্ছেদ করেছে। তবে কেন এটিকে অবৈধ বলা হচ্ছে বা কেন উচ্ছেদ করা হয়েছে, সে বিষয়ে তারা কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি।
বসতির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, মার্চ মাসে উচ্ছেদের পর অনুদানের মাধ্যমে সংগৃহীত এক লক্ষ শেকেলের বেশি অর্থ দিয়ে অর মেয়ার আবার গড়ে তোলা হয়। ইসরায়েল অতীতে যেসব ঘাঁটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে, তার অনেকগুলোই আগে সেনাবাহিনী উচ্ছেদ করেছিল। অর মেয়ারের ঠিক উত্তরে রোড ৬০–এ অবস্থিত অফরা শুরুতে এমনই একটি ঘাঁটি ছিল, যা এখন একটি বড় আবাসন প্রকল্প।

স্মোত্রিচ জানান, ২০২২ সালের শেষ দিকে মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরের বসতিগুলোর জন্য ৫১ হাজার ৩৭০টি আবাসন ইউনিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এটিকে ২০১৭ সালের পর থেকে বসতি সম্প্রসারণের সবচেয়ে দ্রুতগামী ধাপ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
৩০ সেপ্টেম্বর অর মেয়ারের টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত একটি মানচিত্রে ঘাঁটির অবস্থান দেখানো হয়। সেখানে নীল সীমানা দিয়ে একটি বড় এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা দেইর দিবওয়ানের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। দেইর দিবওয়ান পরিষদের মতে, ওই সীমানার ভেতরে ফিলিস্তিনিদের ওপর অন্তত চারটি হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানে তাদের ২৫০ দুনাম ব্যক্তিগত জমিতে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে না।
মানচিত্রে আরও আটটি কালো চিহ্ন রয়েছে, যেগুলোকে ‘পরিত্যক্ত আরব অনুপ্রবেশকারী ঘাঁটি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে যা থেকে বোঝা যায়, এসব স্থান থেকে বেদুঈনদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।
লক্ষ্য জর্দান উপত্যকা
রোড ৬০–এর দুই পাশেই এখন বসতি গড়ে উঠেছে। এই সড়কটি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে জর্দান উপত্যকার দিকে বিস্তৃত। এর পাশেই বেইতা শহরের কাছে অবস্থিত বসতি এভিয়াতার উল্লেখযোগ্য।
২০১৯ সালে এভিয়াতারে ছিল কয়েকটি অস্থায়ী তাঁবু। ২০২১ সালে এটি উচ্ছেদ করা হলেও ২০২৪ সালে ইসরায়েলি সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। এভিয়াতারের মেয়র মালকিয়েল বারহাই এই অনুমোদনের কৃতিত্ব দেন অর্থমন্ত্রী স্মোত্রিচকে।
এভিয়াতারে কথা বলার সময় বারহাই তাঁর প্যান্টে গোঁজা একটি পিস্তল দেখিয়ে বলেন, তিনি এটি আত্মরক্ষার জন্য বহন করেন, কারণ আশপাশের আরব গ্রামগুলোতে বহু ফিলিস্তিনি বসবাস করে।
বেইতা পৌরসভার এক সদস্য জানান, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বেইতার আশপাশে এভিয়াতারসহ বিভিন্ন বসতি থেকে আসা ব্যক্তিরা ১৪ জনকে হত্যা করেছে।
৮ নভেম্বর বেইতার কাছে জলপাই সংগ্রহের সময় বসতি স্থাপনকারীরা লাঠি, গদা ও বড় পাথর ছুড়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়। ওই সময় রয়টার্সের প্রতিনিধিদল সেখানে উপস্থিত ছিল। হামলায় রয়টার্সের দুই কর্মী—একজন সাংবাদিক ও একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা আহত হন। তবে বারহাই এই সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনিদেরই দায়ী করেন।
এভিয়াতারের কাছে বসবাসকারী কৃষক সামের ইউনেস আলি বানি শামসাহ বসতি স্থাপনকারীদের হামলায় এক পা ভেঙে ফেলেছেন। তবুও তিনি নিজের জমি ছাড়তে রাজি নন। তিনি বলেন, “এটাই আমার জায়গা, আমার বাড়ি। আমি কোথায় যাব?”
ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা
এই সব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পশ্চিম তীরে অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। ইসরায়েলের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী এখনও সরাসরি বড় কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। তবে ফিলিস্তিনিরা যদি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সেক্ষেত্রে পশ্চিম তীরও একদিন গাজার মতো ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে পারে।

ইহুদিদের বসতি অর মেয়ার আয়তনে খুবই ছোট। মুষ্টিমেয় কয়েকটি অস্থায়ী আশ্রয় নিয়ে গড়ে ওঠা এই ঘাঁটিটি ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরের একটি পাহাড়ের চূড়ায়, কাঁচা রাস্তার একেবারে শেষে অবস্থিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ এসব আশ্রয়ই একটি পূর্ণাঙ্গ ইসরায়েলি আবাসন প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার সদস্যরাও স্বীকার করেছেন, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের উত্থান ঠেকানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এই প্রক্রিয়াটি সবসময় অহিংস থাকেনি। এক বেদুঈন পরিবার রয়টার্সকে জানিয়েছে, গত বছর অর মেয়ার থেকে নেমে আসা হামলাকারীরা ককটেল নিক্ষেপ করে ফিলিস্তিনিদের তাদের মালিকানাধীন জমি থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরিবারটি আশঙ্কা করছে, তারা আর কখনো হয়তো সেখানে ফিরতে পারবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে অর মেয়ারের চ্যানেলে প্রকাশিত বার্তাগুলোতে দেখা যায়, বেদুঈন পশুপালকদের উচ্ছেদের মাধ্যমে কৌশলগত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার বিষয়টি তারা উদযাপন করছে। এসব বার্তায় নতুন বসতি স্থাপনকারীদের দৃঢ় সংকল্পও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় ৭৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা যে ভূখণ্ডকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে ইসরায়েলের বসতি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে।
ইসরায়েলি এনজিও পিস নাউ জানিয়েছে, ২০২৫ সালে পশ্চিম তীরে ৮০টি বসতি ঘাঁটি নির্মাণ করা হয়েছে, যা ১৯৯১ সালের পর সর্বোচ্চ। গত ২১ ডিসেম্বর ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা সাবেক বসতিসহ আরও ১৯টি বসতি অনুমোদন দেয়। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ বলেন, যেকোনো উপায়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঠেকানোই তাদের লক্ষ্য।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দল ইসরায়েলি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই পশ্চিম তীরের জমিতে বসতি গড়ে তুলেছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো এসব শিবির গুঁড়িয়ে দিলেও সেগুলো প্রায়ই আবার গড়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বসতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্মোত্রিচ আরও বহু ঘাঁটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
পশ্চিম তীরকে যেভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে
ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই পশ্চিম তীরের প্রধান সড়কগুলোর আশপাশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সব ধরনের বসতিকে সামরিক দখলসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অবৈধ মনে করলেও ইসরায়েল এই অবস্থানের সঙ্গে একমত নয়।
গত সেপ্টেম্বর অর মেয়ারের বসতি স্থাপনকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা হয়, সেখানে বলা হয় ‘এই ভূমিতে আমাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার পর থেকে আমরা নয়টি অবৈধ বেদুঈন ঘাঁটি সরিয়ে দিয়েছি এবং প্রায় ৬ হাজার দুনাম জমি আবার ইহুদি মালিকানায় ফিরিয়ে এনেছি।’ এখানে দুনাম একটি ভূমি পরিমাপের একক, যা প্রায় এক হাজার বর্গমিটারের সমান।
রয়টার্স বেদুঈনদের ওপর চালানো সব হামলা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। প্রায় দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই ঘাঁটির বাসিন্দারা সংবাদ সংস্থাটির সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা নিয়ে রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বিষয়টিকে একটি প্রান্তিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কাজ বলে উল্লেখ করেন এবং দাবি করেন, ফিলিস্তিনিদের হামলায় ইসরায়েলিদের ক্ষয়ক্ষতির খবর গণমাধ্যমে যথাযথভাবে উঠে আসে না।
অর মেয়ারের টেলিগ্রাম চ্যানেলটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে প্রকাশিত বার্তাগুলোতে জমি দখলের সুস্পষ্ট পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রয়টার্সের অনুসন্ধানে একই ধরনের আরও এক ডজন টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জেরুজালেমভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক মিলেনা আনসারি বলেন, “এটি সহিংসতার একটি পদ্ধতিগত ধারা, তাদের কার্যক্রমেই তা স্পষ্ট।”
বেদুঈন পরিবারগুলোর বাস্তবতা
মুসাবাহ পরিবার এই অঞ্চলের একটি বেদুঈন পরিবার। তারা জানায়, জুন মাসে রাতে অর মেয়ারের দিক থেকে আসা লোকজন তাদের ওপর হামলা চালায়। ডিসেম্বরে রয়টার্সের একটি দল সেখানে গেলে তাদের বাড়ি ও গোয়ালঘরের পোড়া ধ্বংসাবশেষ তখনও পড়ে থাকতে দেখা যায়।
৩৯ বছর বয়সী বেদুঈন রাখাল শাহাদা মুসাবাহ বলেন, “আল্লাহর রহমতে আমরা এখানে শান্তিতে বসবাস করছিলাম। সেই রাতে ওরা আগুন লাগাতে শুরু করে এবং সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। আমাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।” তিনি বর্তমানে নিকটবর্তী ফিলিস্তিনি গ্রাম দেইর দিবওয়ানে আশ্রয় নিয়েছেন।
এই ঘটনার বিষয়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, ওই রাতে কয়েক ডজন ইসরায়েলি বেসামরিক ব্যক্তি দেইর দিবওয়ানের সম্পত্তিতে আগুন দেয়, তবে নিরাপত্তা বাহিনী পৌঁছানোর আগেই তারা সরে পড়ে। দেইর দিবওয়ান পরিষদের এক কর্মকর্তা জানান, প্রায় ৬০ জন ইসরায়েলি এই হামলায় জড়িত ছিল। তাদের নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে কয়েকজন গ্রামবাসী আহত হন।
একটি টেলিফোন কলে অর মেয়ারের বসতি স্থাপনকারী এলকানাহ নাখমানি রয়টার্সের প্রতিবেদকদের ঘাঁটির দিকে না এগোতে হুমকি দেন এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। নভেম্বর ২০২৪ সালে অর মেয়ারের বসতি স্থাপনকারীরা অভিযোগ করেন, ফিলিস্তিনিরা তাদের ভেড়া বিষ দিয়ে হত্যা করেছে যদিও মুসাবাহ পরিবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরায়েলি পর্যবেক্ষক সংস্থা ইয়েশ দিন জানায়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে তারা বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার শত শত ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, তবে মাত্র ২ শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। রয়টার্স এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। ইসরায়েলের পুলিশ ও সামরিক বাহিনী এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে পশ্চিম তীরে এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অধিকাংশই ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে এবং কিছু বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতায়। একই সময়ে ফিলিস্তিনিদের হামলায় ৫৭ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন।
অস্থায়ী শিবির থেকে স্থায়ী বসতি
অর মেয়ার গোষ্ঠী তাদের লক্ষ্য নিয়ে প্রকাশ্যেই কথা বলে আসছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে তাদের টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে জানানো হয়, তারা অফরা অঞ্চলের কাছে একটি কৌশলগত পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়তে চায়, যার উদ্দেশ্য পশ্চিম তীরকে খণ্ডিত করে সেখানে ইহুদি উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী রয়টার্সকে জানায়, অর মেয়ারে বসতি স্থাপন অবৈধ এবং নিরাপত্তা বাহিনী একাধিকবার এটি উচ্ছেদ করেছে। তবে কেন এটিকে অবৈধ বলা হচ্ছে বা কেন উচ্ছেদ করা হয়েছে, সে বিষয়ে তারা কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি।
বসতির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, মার্চ মাসে উচ্ছেদের পর অনুদানের মাধ্যমে সংগৃহীত এক লক্ষ শেকেলের বেশি অর্থ দিয়ে অর মেয়ার আবার গড়ে তোলা হয়। ইসরায়েল অতীতে যেসব ঘাঁটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে, তার অনেকগুলোই আগে সেনাবাহিনী উচ্ছেদ করেছিল। অর মেয়ারের ঠিক উত্তরে রোড ৬০–এ অবস্থিত অফরা শুরুতে এমনই একটি ঘাঁটি ছিল, যা এখন একটি বড় আবাসন প্রকল্প।

স্মোত্রিচ জানান, ২০২২ সালের শেষ দিকে মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরের বসতিগুলোর জন্য ৫১ হাজার ৩৭০টি আবাসন ইউনিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এটিকে ২০১৭ সালের পর থেকে বসতি সম্প্রসারণের সবচেয়ে দ্রুতগামী ধাপ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
৩০ সেপ্টেম্বর অর মেয়ারের টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত একটি মানচিত্রে ঘাঁটির অবস্থান দেখানো হয়। সেখানে নীল সীমানা দিয়ে একটি বড় এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা দেইর দিবওয়ানের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। দেইর দিবওয়ান পরিষদের মতে, ওই সীমানার ভেতরে ফিলিস্তিনিদের ওপর অন্তত চারটি হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং সেখানে তাদের ২৫০ দুনাম ব্যক্তিগত জমিতে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে না।
মানচিত্রে আরও আটটি কালো চিহ্ন রয়েছে, যেগুলোকে ‘পরিত্যক্ত আরব অনুপ্রবেশকারী ঘাঁটি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে যা থেকে বোঝা যায়, এসব স্থান থেকে বেদুঈনদের উচ্ছেদ করা হয়েছে।
লক্ষ্য জর্দান উপত্যকা
রোড ৬০–এর দুই পাশেই এখন বসতি গড়ে উঠেছে। এই সড়কটি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে জর্দান উপত্যকার দিকে বিস্তৃত। এর পাশেই বেইতা শহরের কাছে অবস্থিত বসতি এভিয়াতার উল্লেখযোগ্য।
২০১৯ সালে এভিয়াতারে ছিল কয়েকটি অস্থায়ী তাঁবু। ২০২১ সালে এটি উচ্ছেদ করা হলেও ২০২৪ সালে ইসরায়েলি সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। এভিয়াতারের মেয়র মালকিয়েল বারহাই এই অনুমোদনের কৃতিত্ব দেন অর্থমন্ত্রী স্মোত্রিচকে।
এভিয়াতারে কথা বলার সময় বারহাই তাঁর প্যান্টে গোঁজা একটি পিস্তল দেখিয়ে বলেন, তিনি এটি আত্মরক্ষার জন্য বহন করেন, কারণ আশপাশের আরব গ্রামগুলোতে বহু ফিলিস্তিনি বসবাস করে।
বেইতা পৌরসভার এক সদস্য জানান, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বেইতার আশপাশে এভিয়াতারসহ বিভিন্ন বসতি থেকে আসা ব্যক্তিরা ১৪ জনকে হত্যা করেছে।
৮ নভেম্বর বেইতার কাছে জলপাই সংগ্রহের সময় বসতি স্থাপনকারীরা লাঠি, গদা ও বড় পাথর ছুড়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়। ওই সময় রয়টার্সের প্রতিনিধিদল সেখানে উপস্থিত ছিল। হামলায় রয়টার্সের দুই কর্মী—একজন সাংবাদিক ও একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা আহত হন। তবে বারহাই এই সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনিদেরই দায়ী করেন।
এভিয়াতারের কাছে বসবাসকারী কৃষক সামের ইউনেস আলি বানি শামসাহ বসতি স্থাপনকারীদের হামলায় এক পা ভেঙে ফেলেছেন। তবুও তিনি নিজের জমি ছাড়তে রাজি নন। তিনি বলেন, “এটাই আমার জায়গা, আমার বাড়ি। আমি কোথায় যাব?”
ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা
এই সব ঘটনার প্রেক্ষাপটে পশ্চিম তীরে অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। ইসরায়েলের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী এখনও সরাসরি বড় কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। তবে ফিলিস্তিনিরা যদি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সেক্ষেত্রে পশ্চিম তীরও একদিন গাজার মতো ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে পারে।

ইহুদিদের বসতি অর মেয়ার আয়তনে খুবই ছোট। মুষ্টিমেয় কয়েকটি অস্থায়ী আশ্রয় নিয়ে গড়ে ওঠা এই ঘাঁটিটি ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরের একটি পাহাড়ের চূড়ায়, কাঁচা রাস্তার একেবারে শেষে অবস্থিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ এসব আশ্রয়ই একটি পূর্ণাঙ্গ ইসরায়েলি আবাসন প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।