আইসিজির প্রতিবেদন

‘ভারতবিরোধী বক্তব্য থেকে বিরত থাকা’র পরামর্শ

চরচা প্রতিবেদক
চরচা প্রতিবেদক
‘ভারতবিরোধী বক্তব্য থেকে বিরত থাকা’র পরামর্শ
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। ছবি: আইসিজির ওয়েবসাইট

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়া’ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। আজ মঙ্গলবার প্রকাশিত এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি এ পরামর্শ দেয়।

আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ভারতের জন্য ছিল বড় ধরনের এক ধাক্কা। এরপর থেকেই ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, সীমান্ত বিরোধ, পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আর উসকানিমূলক বক্তব্য–সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দুই দেশের চলমান অস্থিতিশীল সম্পর্ক নতুন করে ঢেলে সাজানোর সুযোগ করে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে অস্থিতিশীল সম্পর্ক চলছে, এটি যদি আরও খারাপ হয়, তাহলে দুই দেশের অভিন্ন সীমান্ত আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এতে করে চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এ প্রেক্ষাপটেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়া’ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে আইসিজি। একই সঙ্গে নয়াদিল্লিকে নতুন করে বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তেজনা না বাড়াতে এবং বাংলাদেশে সম্ভাব্য অংশীদারদের অবমূল্যায়ন করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসনে উভয় দেশকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে নয়াদিল্লির যে অব্যাহত সমর্থন পেয়েছেন, তা বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব প্রবল করে তুলেছে বলে মনে করে ক্রাইসিস গ্রুপ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঐতিহাসিকভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য হলেও সীমান্ত বিরোধ, আধিপত্যবাদী আচরণ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রায়ই টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। ২০০৮ সালের পর শেখ হাসিনার শাসনামলকে ভারত ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। এ সময়ে দুই দেশ স্থল ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণসহ অর্থনৈতিক সংহতি ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করে। তবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয় যে, ভারত বাংলাদেশ থেকে শুধু রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও ব্যবসায়িক সুবিধা নিয়েছে একতরফাভাবে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়াটা সাধারণ বাংলাদেশিদের ক্ষোভের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে।”

প্রতিবেদনে ক্রমশ অজনপ্রিয় হয়ে পড়া এক শাসককে দিনের পর দিন সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় ভারতের সমালোচনা করেছে ক্রাইসিস গ্রুপ। পাশাপাশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন করবে না বলেই মনে করে ক্রাইসিস গ্রুপ।

সংস্থাটি মনে করে, ভারত এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের দিকেই তাকিয়ে আছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির কারণে বিএনপিকেই এ নির্বাচনে প্রধান শক্তি হিসেবে মনে করছে ভারত। ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির সঙ্গে যদিও ভারতের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। তবুও বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থ রক্ষায় বিএনপিই ভারতের জন্য ‘সেরা বিকল্প’ হতে পারে।

তবে দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধাও চিহ্নিত করেছে ক্রাইসিস গ্রুপ। এগুলোর মধ্যে আছে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়া, ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসন নিয়ে কঠোর নীতি–দুই দেশের মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস আরও বাড়াতে পারে। এ ছাড়া গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া, আর ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে নির্বাচন অদূর ভবিষ্যতে উত্তেজনার কারণ হতে পারে। এ ধরনের অস্থিতিশীলতা সহিংস বিক্ষোভ, সাম্প্রদায়িক হামলা বা সীমান্ত হত্যার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।

আইসিজির মতে, এ অবস্থায় ভারতের উচিত শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর কথাও বলছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে পরামর্শ দিয়েছে, দুই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সংহতি সুসংহত করা। ভারতকে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

নয়াদিল্লির নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়টির সুরাহা করার জন্য বাংলাদেশকেও পরামর্শ দিয়েছে আইসিজি। একই সঙ্গে ‘ভারতবিরোধী বক্তব্য’ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিরত থাকার আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি বিদ্রোহ, চরমপন্থা ও চোরাচালান রোধে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য জরুরি বলেও মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।

সম্পর্কিত