দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন রুপার্ট মারডক। সম্প্রতি মারডক পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্বের সুর শোনা যাচ্ছে। ৯৪ বছর বয়সী রুপার্ট মারডক ব্যবসার স্বার্থে নিজের পরিবারকে ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নেভাদার একটি আদালতে এই পরিবারের একটি মামলা প্রকাশ্যে আসে। সেই মামলার রায় অনুযায়ী, রুপার্ট মারডকের মেয়ে এলিজাবেথ ও তার দুই ভাইবোন পারিবারিক ব্যবসা থেকে বাইরে থাকবেন।
রুপার্টের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেওয়া জ্যেষ্ঠ সন্তান এলিজাবেথ প্রযোজনা সংস্থা ‘সিস্টার’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠানটির হাত ধরেই ব্ল্যাক ডাভস, দ্য স্প্লিট ও দিস ইজ গোয়িং টু হার্টের মতো জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ তৈরি হয়েছে। তিনি একজন উদার, বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী ব্যক্তি।
২০২৫ সাল অত্যন্ত কঠিন একটি বছর ছিল মারডক পরিবারের জন্য। যদিও এলিজাবেথ, তার ছোট ভাই জেমস এবং সৎ বড় বোন প্রুডেন্স প্রত্যেকেই বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন। জেমস মারডকের সঙ্গে তার বাবা রুপার্ট এবং বড় ভাই লকল্যানের সম্পর্ক এখন খাঁদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। চলতি বছরের শুরুতে আমেরিকার ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিক-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেমস তার বাবাকে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলেন এবং আদালতে রুপার্টের কিছু আচরণকে ‘বিকৃত’ বলে উল্লেখ করেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এলিজাবেথ ও প্রুডেন্সকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফক্স কর্প ও নিউজ কর্প থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ জেমস। রুপার্টের মৃত্যুর পর কোম্পানিগুলোকে তারা আরও উদারপন্থী পথে নিয়ে যেতে পারে- এই আশঙ্কা থেকে মিডিয়া সম্রাট ট্রাস্টের শর্ত পরিবর্তন করেন। আগের শর্তানুযায়ী মৃত্যুর পর চার জ্যেষ্ঠ সন্তানকে সমান নিয়ন্ত্রণ দেওয়ার কথা ছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে লকল্যান মারডকই নিশ্চিতভাবে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
রুপার্ট মারডকের ছেলে লকল্যান মারডক। ছবি: রয়টার্সবাস্তবে রুপার্ট ও লকল্যান মারডক আদালতের লড়াইয়ের প্রথম ধাপে হেরে যান। ১৯৯৯ সালে ট্রাস্টটি গঠনের বছরে রুপার্ট তার দ্বিতীয় স্ত্রী আন্নার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন। রুপার্ট-আন্নার সন্তানই লকল্যান, এলিজাবেথ ও জেমস। বিচারক রায় দেন, ট্রাস্ট পরিবর্তনের চেষ্টা সদিচ্ছা থেকে করা হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত বিবাদমান পক্ষগুলো একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। জেমস, এলিজাবেথ ও প্রুডেন্স তাদের শেয়ার বিক্রি করতে সম্মত হন।
লকল্যান মারডক ২০১৯ সালে ফক্স কর্পের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০২৩ সালে তার বাবা চেয়ারম্যান ইমেরিটাস হলে তিনি ফক্স ও নিউজ কর্প- উভয়েরই চেয়ারম্যান হন। লকল্যানের নেতৃত্বে ফক্স কর্পের শেয়ারদর দ্বিগুণ হয়েছে। এর ফলে ভাইবোনদের শেয়ার কিনে নিতে তাকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে- যা নিঃসন্দেহে এক অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক প্যাডি ম্যানিং দ্য সাকসেসর: দ্য হাই স্টেকস লাইফ অব লকল্যান মারডক বইটির লেখক। তিনি বলেন, রুপার্ট মারডকের ৭০ বছরের কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারণেও তার ভূমিকা ছিল।
মারডকের ছেলে লকল্যানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ লকল্যান তার বাবার মতো রাজনীতি নিয়ে অত আগ্রহী নয়, ব্যবসাতেই তার মনোযোগ বেশি। ডিজিটাল রিয়েল এস্টেট থেকে শুরু করে জুয়া, বাণিজ্যিক রেডিও থেকে টুবি- ল্যাকলানের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তগুলোর লক্ষ্য হলো মুনাফা, রাজনৈতিক ভাবমূর্তি জোরদার করা নয়।”
তবে অধ্যাপক বেনসনের মতে, ভাইবোনদের সঙ্গে সমঝোতার ফলে লকল্যান মারডকের ব্যবসাগুলো বিপুল ঋণ নিয়েছে, ফলে লাভ অর্জন করা কঠিন হতে পারে।
রুপার্ট ও আন্নার বিবাহবিচ্ছেদের সমঝোতার অংশ হিসেবে যে পরিবারিক ট্রাস্ট গঠিত হয়েছিল, রুপার্টের মৃত্যুর পর সন্তানদের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করবে বলে ভেবেছিলেন আন্না। কিন্তু নেভাদার আদালতের লড়াই ও পরবর্তী সমঝোতার মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আর এর সঙ্গে সঙ্গে, তাঁর ছয় সন্তানের মধ্যে তিনজনের সঙ্গে সম্পর্কও হয়তো চিরতরে ভেঙে গেছে।