২০২৬ সালে বাংলাদেশে সংঘাতের ঝুঁকি কতটা, যা বলছে মার্কিন সংস্থা

২০২৬ সালে বাংলাদেশে সংঘাতের ঝুঁকি কতটা
২৮ অক্টোবর ২০২৩, বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ছবি: সুদীপ্ত সালাম

আমেরিকারভিত্তিক প্রভাবশালী থিঙ্ক ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর) তাদের সাম্প্রতিক ‘প্রিভেন্টিভ প্রায়োরিটি সার্ভে ২০২৬’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি চলতি মাসেই প্রকাশিত হয়েছে।

সিএফআর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির সদস্যদের মধ্যে রাজনীতিক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সিআইএ পরিচালক, ব্যাংকার, আইনজীবী, অধ্যাপক, করপোরেট পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং খ্যাতনামা গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা রয়েছেন।

সিএফআর বলছে, শুরু হতে যাওয়া বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বড় ধরনের অস্থিরতা এবং রক্তক্ষয়ী সহিংসতার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।

বাংলাদেশের অবস্থান ও ঝুঁকির মাত্রা

সিএফআর-এর ‘সেন্টার ফর প্রিভেন্টিভ অ্যাকশন’ প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে সম্ভাব্য সংঘাতের উৎসগুলো নিয়ে এই জরিপ পরিচালনা করে। ২০২৬ সালের তালিকায় বাংলাদেশকে টায়ার-৩ বা তৃতীয় সারির ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে রাখা হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৬২০ জন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদের মতে, বাংলাদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত ঘটার আশঙ্কা ‘মাঝারি’। যদিও মার্কিন স্বার্থের ওপর এর প্রভাব কম হিসেবে ধরা হয়েছে, তবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য এটি একটি বড় সতর্কবার্তা।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতা। ছবি: সুদীপ্ত সালাম
২০১৮ সালের জুলাইয়ে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতা। ছবি: সুদীপ্ত সালাম

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতার জন্য মূলত দুটি প্রধান বিষয়কে দায়ী করা হয়েছে। একটি হলো জাতীয় নির্বাচন স্থগিত হওয়া বা বিলম্বিত হওয়া এবং ক্রমবর্ধমান শাসনতান্ত্রিক সংকট।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনিশ্চয়তা জনমনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। এই রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা ধর্মীয় সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

নিউইয়র্ক-ভিত্তিক সংস্থাটির প্রতিবেদনে আরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। বিশেষ করে লৈঙ্গিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার আশঙ্কা এই অস্থিরতাকে এক নতুন মাত্রা দিতে পারে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার এই পূর্বাভাস বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

প্রতিবেদনে সরাসরি অর্থনীতির কথা না থাকলেও, রাজনৈতিক সহিংসতার উচ্চ ঝুঁকি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প এবং সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতা দেখা দিলে মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা এবং মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করতে পারে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।

প্রতিবেদনে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধকেও একটি অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতি এবং সীমান্তের ওপারে চলমান যুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে আগে থেকেই চাপে রেখেছে।

সিএফআর-এর মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি চরমে পৌঁছায়, তবে এই শরণার্থী সংকট নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। মাদক ও অস্ত্র পাচারের মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধগুলোও এই অস্থিতিশীল পরিবেশে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া টায়ার ৩ এ রয়েছে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের নাম। সেখানে পুনরায় সংঘাত শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল। সেখানে ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং মানবিক দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

এই টায়ারে আরও রয়েছে নাইজেরিয়া। সেখানে জঙ্গি এবং দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা দেশব্যাপী নিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যদের মহড়া। ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যদের মহড়া। ছবি: রয়টার্স

টায়ার ৩ এ রয়েছে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাম। সেখানে রুয়ান্ডা-সমর্থিত মিলিশিয়াসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে জাতিগত ও রাজনৈতিক সংঘাত তীব্রতর হচ্ছে।

এই স্তরে আরও রয়েছে ইকুয়েডর, ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, ক্যামেরুনের নাম। এসব দেশেও রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ বিদ্যমান।

সিএফআর-এর জরিপ মূলত হোয়াইট হাউস ও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো নীতিনির্ধারণী মহলে অগ্রিম সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে যে, ওয়াশিংটন এই অঞ্চলের ক্ষমতার পরিবর্তন এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। যদিও সরাসরি মার্কিন ভূখণ্ডে এর প্রভাব কম, তবে একটি অস্থিতিশীল বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন কৌশলের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সিএফআর-এর এই বার্ষিক জরিপ মূলত মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অগ্রিম সতর্ক করার জন্য তৈরি করা হয়, যাতে তারা সম্ভাব্য সংঘাত নিরসনে পদক্ষেপ নিতে পারেন । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে না পারলে আগামী বছরটি দেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

আন্তর্জাতিক এই মূল্যায়নটি এমন এক সময়ে এলো যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ ও সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের প্রতিবেদন বৈশ্বিক বিনিয়োগ এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

সম্পর্কিত